সাম্প্রতিক খবর

জানুয়ারী ১৭, ২০২০

অচলাবস্থার দ্বারপ্রান্তে অর্থনীতি: ডাঃ অমিত মিত্র

অচলাবস্থার দ্বারপ্রান্তে অর্থনীতি: ডাঃ অমিত মিত্র

আজ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন বাংলার শিল্প, অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রী ডঃ অমিত মিত্র। সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের তিনি উত্তর দিয়েছেন। দেখে নেওয়া যাক প্রশ্ন এবং উত্তরগুলি।

প্রশ্নঃ দেশের অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে? এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন?

ডঃ অমিত মিত্রঃ আমার মনে হয় অর্থনৈতিক অবস্থা শুধু খারাপ নয়, মন্দাও চলছে। অচলাবস্থা আসতে চলেছে শীঘ্রই। জিডিপি বৃদ্ধির হার দেখুন। আত্মঘাতী নোটবন্দী করার পর থেকে জিডিপি সমানে কমছে। ওনারা বলেছিলেন সার্জিকাল স্ট্রাইক কিন্তু, বাস্তবে এটা আত্মঘাত।

যখন ৮ শতাংশ ৮.২ শতাংশ জিডিপি বারছিল, হঠাৎ করে পরিকল্পনাহীন নোটবন্দী। বৃদ্ধির হার কমে এলো ৭.২ শতাংশ, ৬.৮ শতাংশ এবং এই বছর ৫ শতাংশে। কয়লা, ইস্পাত, সিমেন্ট শিল্পে ৫.৮ শতাংশ মন্দা ছিল অক্টোবর মাসে। ইস্পাতে ছিল ৩.৭ শতাংশ মন্দা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গত অক্টোবরে ১.৪২ শতাংশ মন্দা। রপ্তানিতেও ৪.২ শতাংশ মন্দা।

প্রশ্নঃ বারবার অচলাবস্থা শব্দটা শোনা যাচ্ছে। এটা একটু বোঝান।

ডঃ অমিত মিত্রঃ সাধারণত, মূল্যবৃদ্ধিতে অনেক অতিরিক্ত চাহিদা তৈরী হয়। বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধির যখন কোনও সম্পর্ক থাকে না। ১৯৭০ সালে আমেরিকাতে এই ঘটনা ঘটেছিল। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম।

প্রশ্নঃ আপনার কি মনে হয় এই অবস্থার জন্য সরকার দায়ী? নির্মলা সীতারমন কি এই অবস্থা কাটাতে কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেন?

ডঃ অমিত মিত্রঃ মাসের পর মাস সরকার অস্বীকার করে গেছে। প্রথমে রোগ স্বীকার করতে হবে, তারপর তার দাওয়াই খুঁজতে হবে। এমনকি কয়েকদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বললেন অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো, চিন্তার কিছু নেই। প্রথমে স্বীকার করতে হবে। সমস্ত তথ্যে বোঝা যাচ্ছে আসল অবস্থা কি? এখন প্রশ্ন হল ওনারা কি ভাবছেন? একটা উদাহরণ দিই, একটি কারচুপির কথা মানুষ বলছে না। জিএসটিতে ৪৪ হাজার কোটি টাকার কারচুপি হয়েছে – রাজ্যসভায় অর্থ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ১৪০০ গুণ। অচলাবস্থার সঙ্গে এই কারচুপি মারাত্বক।

প্রশ্নঃ আপনি বলছেন সরকার এই সমস্যা মানতে নারাজ? সরকার কর্পোরেট ট্যাক্সে বিশাল ছাড় দিয়েছে। তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে কেন হচ্ছে না?

ডঃ অমিত মিত্রঃ কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ে একটি বিষয় তৈরী হয়েছে, কর্পোরেট লাভ বেড়েছে ১১ শতাংশ। এবার আপনি কর ছাড় দিলেন ১০ শতাংশ। প্রশ্ন হল তারা কি বিনিয়োগ করছে? বড় বড় শিল্পপতিদের খাতায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা পরে আছে। আপনি কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় দিচ্ছেন কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে টাকা দিচ্ছেন না। ওনারা বিনয়োগ করলে, যন্ত্র, শিল্পাঞ্চল, প্রয়োজন যাতে টাকা আসতো এবং কর্মসংস্থান তৈরী হত। তারা সেটা করছেনা। তারা নিশ্চিত নয় বলেই বিনিয়োগ করছে না। ১৮৮১ তে একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন অ্যালফ্রেড মার্শাল, তিনি বলেছিলেন, এই সমস্যা হচ্ছে অনিশ্চয়তা থেকে। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদের ওপর তদন্ত চালানো হচ্ছে। বিনিয়োগ কোথায়?

প্রশ্নঃ কেন তারা বিনিয়োগ করছেন না? তাদের কি ভয়?

ডঃ অমিত মিত্রঃ অনেক কারণ আছে। যখন জিডিপি ৫ শতাংশে এসে ঠেকে, মানুষের কাছে টাকা নেই জিনিসপত্র কেনার। প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডঃ সুভ্রমনিয়ন স্বামী অর্থনৈতিক সমীক্ষা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে। ওই রিপোর্ট পরে আমি আশঙ্কিত। কঞ্জিউমার গুডসের উৎপাদন অনেক কমেছে জা ১৯৯১-৯২ সালের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেহেতু বিনিয়োগ নেই, তাই চাহিদাও নেই। কলকাতার এক শিল্পপতি যার লেনদেন ২০ হাজার কোটি টাকা তার নামে ইডির ৩১টি মামলা আছে। এজন্য অনেক চ্যানেলে তিনি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেছেন।

প্রশ্নঃ দেশজুড়ে এই মন্দা। বাংলায় এর প্রভাব কি?

ডঃ অমিত মিত্রঃ আমি আপনাদের খুব আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই ২০১৮-১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছে ১২.৫৮ শতাংশ। এবছরেও যেখানে সারা দেশের বৃদ্ধি ৫ শতাংশ, সেখানে বাংলার বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ১০ শতাংশ হবে।

প্রশ্নঃ আপনারা তাহলে এক নম্বর। অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, তেলেঙ্গানা আপনাদের পরে। আপনারা কি করছেন যাতে এই মন্দার মধ্যেও আপনাদের বৃদ্ধি হচ্ছে?

ডঃ অমিত মিত্রঃ প্রথম, সরকারের মূলধনী ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। এর ফলে সম্পত্তি তৈরী হচ্ছে। পরিকল্পিত ব্যয়, মূলধনী ব্যয় বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা আছে।দ্বিতীয়ত, আপনারা জেনে খুশী হবেন, বাংলায় রাজ্যস্তরের ব্যাঙ্কগুলি সরকারের নির্দেশে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক বছরে। ভারতের ৯৩ শতাংশ কর্মসংস্থান অসংগঠিত ক্ষেত্রে। আমি ব্যাঙ্কগুলিকে তিন বছর আগে ৩৮ হাজার কোটি টাকার লক্ষমাত্রা দিয়েছিলাম। তারা ঋণ দিয়েছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা, তারা দিয়েছিল ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এই বছর এই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়ে গেছে। এতে কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা আসছে। 

অন্যদিকে, পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। ২৭ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা তৈরী হয়েছে। এতে কত সাধারণ মানুষ টাকা পেয়েছে ভাবুন। 

তৃতীয় কৌশল হল, টিসিএস ৪৫ হাজার জনকে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর পর আরও ১৫ হাজার জনকে নেওয়া হবে। এর ফলে বেঙ্গালুরুর থেকেও বেশী কর্মসংস্থান হবে এখানে।

 প্রশ্নঃ আপনারা পরিকাঠামোয় অনেক ঋণ দিচ্ছেন, অনেকে বলবে এতে কেন্দ্রীয় সরকার উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু এতে অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে না। বাজেটের কাছে পৌঁছে নির্মলা সীতারমন কি করবেন এই মন্দা থেকে বেরোতে? 

ডঃ অমিত মিত্রঃ প্রথমত আমি বলতে চাই, একবার অচলাবস্থা শুরু হলে, সেটা আটকানোর কোনও রাস্তা অর্থনীতিবীদদের কাছে নেই। সরকার কোনও মানুষের উপদেশ নেয়না। উপদেশ নিলে বুঝতে পারতেন অচলাবস্থা মোকাবিলা করার কোনও রাস্তা কাউর কাছে নেই। ১৯৭০ সালের আমেরিকার দিকে তাকালে আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি এর জন্য শঙ্কিত। সরকার জিএসটির ভর্তুকি দিতে পারছেনা রাজ্যগুলিকে। কর্পোরেট কর কমে গেছে। কোথা থেকে টাকা পাবে? টাকা ছাপিয়ে বাজারে আনলে মূল্যবৃদ্ধি আরও বাড়বে। দেশের অর্থনীতি কোণঠাসা হয়ে গেছে।

প্রশ্নঃ আপনি দেশের অর্থমন্ত্রী হলে কি করতেন?

ডঃ অমিত মিত্রঃ আমি কখনোই ওই হটসিটে বসব না কারন আমি এই অবস্থা হতে দিতাম না। আর একান্ত বসলেও আমার কিছু করার থাকতো না। আমি অর্থনীতিতে টাকা ঢোকাতে পারতাম না। পাঁচবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাল। এতে কি বিনিয়োগ বেড়েছে? বাড়েনি। এই চিন্তাশক্তিহীন সরকার দেশকে এক বাক্সতে বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থনীতির দিক দিয়ে উন্নতির জায়গা নেই। আমি এজন্য দুঃখিত। 

প্রশ্নঃ একইসঙ্গে রাজ্যগুলির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাংলার কত পাওনা?

ডঃ অমিত মিত্রঃ শুধু জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ বাংলার বকেয়া ২.৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ৩৭ হাজার কোটি টাকা পাওনা আছে বাংলার। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সব নথি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন। 

প্রশ্নঃ সম্প্রতি জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠক থেকে বেড়িয়ে আপনি বলেছেন, কাউন্সিলে একটি প্রেজেন্টেশনে সরকার জানিয়েছে ফেব্রুয়ারির পর আপনাদের দেওয়ার টাকা আর তাদের নেই। এটা কি ঠিক?

ডঃ অমিত মিত্রঃ ওই প্রেজেন্টেশন খুব আশঙ্কাজনক ছিল। ৪৪ হাজার কোটি টাকার জিএসটি কারচুপি হয়েছে এই ভুলভাল জিএসটির জন্য। অনেকে জালি কোম্পানি তৈরী করেছে, জালি লেনদেন করছে এবং আপনারা ইনপুট কর করেছেন, পুরো চেনটাই জালি। আপনারা কি করে ক্ষতিপূরণ দেবেন যেখানে ৪৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি? ফেব্রুয়ারিতে সরকার ভয়ঙ্কর শঙ্কটে পড়বে, প্রদেয় টাকা দিতে পারবে না। রাজ্য সমস্ত কর ছেড়ে দিয়েছে, ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ কর কেন ছাড়া হয়েছে? বিশ্বের বৃহত্তম কর সংস্কারের জন্য।  

 প্রশ্নঃ আপনি বলুন কি করা উচিৎ? 

ডঃ অমিত মিত্রঃ আমি ভয় পাচ্ছি যে কোনও উপায় নেই। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা দিতে হবে যাতে চাহিদা বাড়ে। অনেক রাস্তা আছে সেটা করা। আমরা ১০০ দিনের কাজে দেশের সেরা রাজ্য। এতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা যায়। কারচুপি রুখতে সেরা সরকার। এখন দেশ ক্যাচ ২২ অবস্থায় পড়েছে – কোনও অর্থনৈতিক উৎস নেই মূল্যবৃদ্ধিকে ঠিক রেখে, সুদের হার কমালে কোনও লাভ নেই, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। বৃদ্ধির হার কম না, মন্দা চলছে। শেষবার আমরা ১৯৯১ সালে এই অবস্থায় পড়েছিলাম। ২০০১-০২ সালেও এই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু, সেই সময় অন্যান্য নির্ধারকগুলো সবল ছিল ডঃ সুভ্রামনিয়ন স্বামীর মতে। ওনার গবেষণা সঠিক। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব কিছু করার নেই। 

 প্রশ্নঃ আপনাদের মত বিরোধী দলের রাজ্যগুলি কেন অন্যরকম মোকাবিলা করছেন? দুটি রাজ্য বলেছে এনপিআর করবে না।

ডঃ অমিত মিত্রঃ আপনাদের একটি বড় ঘটনা বলি। আমরা কেন করছি, এর পেছনে সুবৃহৎ কারন আছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ছিল, এখন শুনছি আগামী চার মাসে আকাশছোঁয়া রাম মন্দির হবে। তাই এবারের আদমসুমারিতে এমন কিছু প্রশ্ন করা হবে, যা আগে জানতে চাওয়া হয়নি এবং সেই ভিত্তিতে তাদের দেশ থেকে বিতারন করা হবে। কোথায়? আরব সাগরে? বঙ্গোপসাগরে? সব সাজানো আছে। কেন? কারন, সরকার ভাবছে তারা নির্বাচন জিতেছে, অর্থনীতি নয়, সংস্কার নয়, বরং উগ্র জাতীয়তাবাদ। এটা আপনাদের বুঝতে হবে। মানুষে মানুষে বিভেদ করলে আপনি জিতবেন। একবার এভাবে জেতার স্বাদ পেলে, সেটা ছাড়া মুশকিল।

প্রশ্নঃ আগের বা এবারের মোদী সরকারের কোনও একটি ক্ষেত্র আছে যেটা প্রশংসনীয়?

ডঃ অমিত মিত্রঃ একটি ভালো বুদ্ধি হতে পারে খামার ক্ষেত্রকে দেখা। সেখানে যদি কিছু সম্পদ দেওয়া যায়, যেমন ব্যাঙ্ক ঋণ। এই প্রকল্পে ব্যাঙ্কের ঋণের ২০ শতাংশ উদ্যোগপতিরা নিয়েছেন। বাকিতা অন্যদিকে গেছে। ভালো উদ্যোগ নষ্ট হয়েছে শিরোনামে থাকার ইচ্ছের জন্য। বীমা ক্ষেত্রে আমরা ৪০:৬০ শতাংশ দিচ্ছি। কিন্তু, হঠাত সেই বীমার কাগজে প্রধানমন্ত্রী নিজের ফটো দেওয়া শুরু করলেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো?

সঞ্চালকঃ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।