জুলাই ৩০, ২০১৮
এনআরসি - একটি মানবিক ইস্যু, মানুষকে ভাগ করার চক্রান্ত: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ অসমের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীর দ্বিতীয় (এবং চূড়ান্ত) খসড়া প্রকাশ করা হয়। ৮০ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম এই খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়। এই ইস্যুকে মানবিকতার সংকট ও মানুষকে ভাগ করার চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে নবান্নে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছু অংশ:
প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালি, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে, তাদের পুরো বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয় যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তারা অনেক ভাবে চেষ্টা করেছেন নিজেদের নাম সংযোজিত করার জন্য।
যেমন দেখুন, এখানে NRC List-এ কারা কারা সংযোজিত হবেন, তার মধ্যে বলেছে, Passport থাকলে হবে, Government-Issued License থাকলে হবে, Any Government Service Employment Certificate থাকলে হবে, Bank or Post Office থাকলে হবে।
আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না ওদের সাথে। কারণ, যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে, সমস্ত ইন্টারনেট বন্ধ আছে অসমে। সুতরাং, they can not contact with the people. এটা খুব চিন্তার। সরকারের যা ফোর্স আছে, সেটা ছাড়াও আরও ১৫ কোম্পানি ফোর্স কেন্দ্রীয় সরকার পাঠিয়েছে। আমাদের মনে সন্দেহ হচ্ছে, এটা কি বুলডোজ করার জন্য? না বিশেষ করে বলপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্য? এটা খুব চিন্তার কারণ যেহেতু সমস্ত কানেকশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা খুব দুঃখজনক।
Political isolation দেখুন, এবং বিজেপি সরকারের isolation দেখুন। নাম, পদবী দেখেও বাদ দিয়েছে। বাংলায় অনেক পদবীর লোক আছে, বাংলাদেশেও আছে। ধরুন, এনার নাম, অন্তোশ চৌধুরী, আধার কার্ডও আছে, Passport আছে, বলছে NRC not satisfied। তার মানে কি বিছিন্ন করার জন্য তারা not satisfied? সুতরাং document দিয়েও এই লোকগুলো বঞ্চিত হয়েছে। Document এ বলেছে Voter ID card, সেটাও জমা দিয়েছে, তাতেও বাদ হয়েছে। আরেকটি নাম চন্দন দত্ত, Voter ID card আছে, অপূর্ব লাল সাহা, SBI এর document।
আপনারা শুনলে তাজ্জব হয়ে যাবেন। আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম ২৩/৩/২০১৮-য়, তাতে বলছে, ৩২ বছর নাটক করে বিদেশী চিহ্নিত করেছিল ৮৬ হাজার ৮৪৯ জনকে। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৬৬৩ জনকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ হয়েছে। ৪১ হাজার ৩৩ জন নিখোঁজ হয়ে গেছে। ৭১ জনকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। আর ৮৩৩ জনকে আসামের ৬টি জেলে রেখেছে, তার মধ্যে ২৮ জন শিশু। এমনকি আমাদের উত্তরবঙ্গের কিছ লোককেও জেলে রেখেছে।
এক রাজ্যের লোক তো আরেক রাজ্যে থাকে, আমাদের রাজ্যে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের লোকেরা থাকে। তাদের কি আমি বলব, they are not Indian? প্রত্যেক রাজ্যেই প্রত্যেক রাজ্যের লোক থাকে, এটা স্বাভাবিক। তেমনি সেই রাজ্যতেও বাংলার লোক থাকে। India is our country. রাতারাতি মুর্শিদাবাদের লোককে, উত্তরবাংলার লোককেও বলে দিচ্ছে, তুমি বিদেশী, নাগরিক নও।
৪০ লক্ষ লোকের যে draft publication হয়েছে, তা খুব ভয়াবহ, মানুষ অসহায়। সততা, সদিচ্ছা আর transparency থাকলে, কেন সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে? যাতে কেউ যোগাযোগ করতে না পারে। আজকে আমরা এই কথাগুলো কেন বলছি, কারণ, বাংলা থেকে আসাম পর্যন্ত সীমান্ত, এটা অন্য রাজ্যের গায়ে অত লাগবে না, আমাদের লাগবে। একই ভাষায় কথা বলেন তারা। একদিকে বাংলাদেশ, একদিকে বাংলা। এই ২টো জায়গায় সবথেকে বেশী সমস্যা হবে। এরা কেউ রোহিঙ্গা নয়, এরা very much Indian। এখানে সবাই ভারতীয় নাগরিক। বিভেদের রাজনীতি করতে গিয়ে, মানুষকে ভাগ করার একটা ছক চলছে। ওদের অভিসন্ধি হল মানুষকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ করবে। মানবিকতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পরিকল্পনা চলছে।
আমাকে অনেক বাইরের লোককে চিকিৎসা দিতে হয়, মানবিকতার খাতিরে। আমি না বলতে পারি না। অসমে অনেকে পাঁচ পুরুষ ধরে আছে, এমনকি ১৯৭১ সালের পর যারা এসেছে, তারাও officially Indian. এরা আজ নিজের দেশেই রিফিউজি হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় সরকার ও অসম সরকারের কারণে আজ এরা রিফিউজি।
আমরা আমরা কোর্ট অর্ডারের বিরোধিতা করেছিলাম, কেন্দ্রীয় সরকার-অসম সরকার সেদিন বিরোধিতা করেনি। Silence is the better supporting tendency. চুপ থেকে তারা এটাকে করতে সুযোগ করে দিয়েছে। সেদিন কেন্দ্রীয় সরকার বলত, কেন আমি এত লোককে তাড়াব? এখনও সরকার পারে। কেন সরকার সংসদে বিল আনল না এদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য? সংশোধনীও করতে পারত। নির্বাচনী রাজনীতি করতে গিয়ে অযথা কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আজ যখন রাজ্যসভায় এই ইস্যুটি আমাদের সাংসদরা তুলেছিলেন তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেস আতঙ্ক তৈরী করছে, এখানে আতঙ্ক করার কোন কারণ নেই। আতঙ্ক করার কিছু যদি নাই থাকে তাহলে ১৫ কোম্পানি ফোর্স কেন পাঠানো হল? ইন্টারনেট পরিষেবা কেন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল? ই-মেল, ফ্যাক্স কিছুই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারও সাথে কোনও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
আমরা ওদের ব্যাপারে ভীষণ উদ্বিগ্ন কারণ, দেশে থেকে যারা আজ দেশের উদ্বাস্তু হয়ে গেল তারা আমাদেরই ভাইবোন। অসমে অসমবাসীদের পাশাপাশি বাঙালি, বিহারী, উত্তরপ্রদেশের লোকজনও আছে, অনেক অবাঙালিও আছে। ওরা বিপদে পড়লে আমরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ব। বাঙালি খেদাও, বিহারী খেদাও চলছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে।বাংলাদেশ না নিলে এরা কোথায় যাবে?
৪০ লক্ষ লোক কোথায় যাবে একবারও কি সরকার ভেবে দেখেছে? এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে, ভারত সরকারের কি উচিত ছিল না আমাদের সবার সাথে বসে একটা বৈঠক করার? এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরাসরি সমস্যায় পরবে, অথচ কেউ একবার আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। আজকে এনআরসি করার পর একজন ফোন করে সামলাতে বলছে। সামলাও মানে? এতদিন হয়ে গেল এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, একবার আমার সাথে বা আমার মুখ্য সচিব, ডিজি বা সরকারের সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি।
এক কলমে বরবাদ – এটা খুব সিরিয়াস ইস্যু। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব এদের বাঁচান – এদের এভাবে বিচ্ছিন্ন করবেন না। এরা সবাই মানুষ। মানবিকতার খাতিরে বলছি, দয়া করে আগুন নিয়ে খেলবেন না। এদের বাঁচানোর জন্য দরকার হলে সংসদ lআইন সংশোধন করতে পারে। এখন সংসদ চলছে, সংসদই ওদের রক্ষা করতে পারে। আমি নিজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সময় চাইবো, দিল্লিতে গিয়ে আমি ওনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলব।
আমরা আমাদের সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে আসামে পাঠাচ্ছি। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে তাই কবে পাঠানো হবে আমি তা জানিয়ে দেব। প্রয়োজন হলে আমি নিজেও যেতে পারি। আমি এটা আইন শৃঙ্খলার ইস্যু হিসেবে দেখছি না, এটাকে আমি বড় মানবিক সমস্যা হিসেবে দেখছি। বাংলার মানুষ অসমবাসী, বিহারবাসীর সাথে, সারা দেশের মানুষের সাথে আছি।
দেশের মধ্যে যারা উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন তারা কোনোরকম সাহায্য চাইলে আমরা তাদের সবরকম সাহায্য করব। তাদের কথা জানিয়ে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সহমর্মিতা জানিয়ে, তারা যাতে ভালো থাকে সেকথা বলার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য আমরা করবো। রাষ্ট্রসংঘের নিয়ম আছে অন্য কোন আন্তর্জাতিক বর্ডারের লোক বিপদে পড়ে এলে তাদের সাহায্য করার, এই রেসোলিউশন আছে। তাই তারা যদি আমাদের ঘরে আসেন আমরা সাহায্য করব। বাংলায় ওরা আসতেই পারে, এলে আমরা ভেবে দেখবো, ওখানে ওদের ঘর বাড়ি আত্মীয়স্বজন সব আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন ওদের তাড়াবে কেন?
আমি খুব চিন্তিত কারণ আজ শান্তি বিঘ্নিত হতে চলেছে। শান্তি বিঘ্নিত হত না যদি সরকার ভোটের রাজনীতি না করে নিজের দায়িত্ব পালন করত।এভাবে ভোটার রাজনীতি করে কতজন কে বাদ দেবেন? কতজন কে lynching করবেন? কতজনকে অত্যাচার করে ভয় দেখিয়ে এভাবে বিচ্ছিন্ন করবেন? এটা ওদের বিভেদের রাজনীতি।