সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫
সেনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ ধর্মতলায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে তৃণমূলের মঞ্চ খুলে দেয় সেনাবাহিনী। বাংলা ভাষার অপমান এবং বাংলাভাষীদের হেনস্থার প্রতিবাদে এই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের কিছু অংশ :
আপনারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন, আমরা বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলাম। কিন্তু তারা মঞ্চ ভেঙে দিয়েছে। সেনারা প্যান্ডেল খুলে দিয়েছে। সেনাদের প্রতি আমার কোনও রাগ নেই, আমরা তাঁদের নিয়ে গর্বিত। কিন্তু তাঁদের জানা উচিত, আমরা কোনো রাস্তা বন্ধ করিনি । কেবল শনিবার-রবিবার আমরা এখানে অনুষ্ঠান করতাম। তার জন্য যথাযথ অনুমতিও আমাদের ছিল। তারা চাইলে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে পারত, পুলিশ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করত, আমরা নিজেরাই মঞ্চ খুলে দিতাম। আমরা সব আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির নিচেই করি, যিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ নেতা।
প্রায় ২০০ জন সেনা আমাকে দেখে দৌড়ে পালাতে শুরু করল। আমি বললাম, কেন দৌড়াচ্ছ? তোমরা তো আমার বন্ধু। এটা তোমাদের দোষ নয়। তোমরা বিজেপি আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নির্দেশেই এটা করেছ। আমি দোষ দিচ্ছি বিজেপিকে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে। যদি সেনাকে ব্যবহার করে মঞ্চ আর সাজসজ্জা ভাঙে, তাহলে আর কী বলব?
গতকাল এখানে অনুষ্ঠান ছিল, আর আজ জায়গা খালি করে দেওয়া হলো। অথচ চাইলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে, কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে জানাতে পারত। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা রাজ্যের বিষয়। কোনও আপত্তি থাকলে আমরা মুহূর্তেই মঞ্চ সরিয়ে নিতাম। আমরা কারও অসুবিধা চাই না। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, এটা সেনারা করেনি, বিজেপি করেছে। এর পেছনে বিজেপির চক্রান্ত আছে। জোর করে এটা করা হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে সেনাকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা সেনাকে দোষ দিচ্ছি না, তাঁরা দেশের জন্য কাজ করেন।
সেনা আর কলকাতা পুলিশকে অসম্মান করা উচিত নয়। কলকাতা পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করলেই হতো। যেমন ডুরান্ড কাপের সময় মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে তারা কথা বলেছিল। আমি তো ওদের সব অনুষ্ঠানেই যাই। তাহলে আজ কেন সেনার দল আমাকে দেখে দৌড়ল? আমি বলেছিলাম, তোমরা আমার বন্ধু, দৌড়িও না। আমি আর এখানে কোনও অনুষ্ঠান করব না।
আমরা এবার আমাদের অনুষ্ঠান রানী রাসমণি রোডে করব। বিজেপি তো এখানে অনুমতি ছাড়াই অনুষ্ঠান করে। তাঁদের জন্যও কি একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে? এটা আমি অগণতান্ত্রিক বলে মনে করি। আমাকে সমস্ত কাজ ফেলে এখানে আসতে হলো। বাংলাভাষা আর বাঙালিদের উপর নির্যাতন চলছে। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে যে কোনও ভাষায় কথা বলার। পুলিশের কাছে জানালেই হতো, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে জোর করে মঞ্চ ভেঙে দিল।
আমাদের ব্যানার আর পতাকা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অগণতান্ত্রিক এবং অনৈতিক। বিজেপি নিজের স্বার্থে সেনাকে ব্যবহার করতে চাইছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের অভ্যন্তরীণ বা সীমান্ত সুরক্ষার দিকে ওরা নজর দিচ্ছে না। শুধু বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই করার জন্য এ সব করছে। যত বেশি করবে, তত খারাপ ফল পাবে।
৩০ ও ৩১ আগস্টের জন্য আমরা ২০,০০০ টাকা জমা দিয়েছিলাম। ওই সময় অন্য কোনও দলের অনুষ্ঠানও ছিল না, আমরা কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে করতাম। কিন্তু বিজেপির কাছ থেকে তো কোনও সিকিউরিটি ডিপোজিট নেওয়া হয় না। আজ যা ঘটেছে আমি বিজেপিকে তার জন্য ধিক্কার জানাই। ওরা দেশের লজ্জা। এই ডবল ইঞ্জিন সরকার দেশের কলঙ্ক। ওরা আর জনসমর্থন পাবে না। সব সংস্থাকে ওরা ললিপপ বানিয়ে দিয়েছে। সেনাকেও যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে নিরপেক্ষতা কোথায়?
ভোট এলেই ওরা সংস্থাগুলোকে পাঠিয়ে আমাদের বদনাম করার চেষ্টা করে। একটাও নিরপেক্ষ সংস্থা কি আছে বলুন? বিজেপি একদিন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন কোথায় যাবে? জনগণই উত্তর দেবে। আমরা ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। অভিষেকের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। পুলিশের অনুমতি নিয়েই আমরা সব করি, এমনকি ২১ জুলাইয়ের কর্মসূচিতেও। রানী রাসমণি রোডেই অনুমতি নিয়ে ভাষা আন্দোলনের মঞ্চ হবে।
তাহলে কি এর মানে ব্রিগেডে বা গান্ধীমূর্তির সামনে আর কোনও অনুষ্ঠান করা যাবে না কারণ সেনা অনুমতি দেবে না? রেড রোডেও অনুষ্ঠান হবে না? রাস্তাঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা—সবই তো কলকাতা পুরসভা আর কলকাতা পুলিশ দেখে। সেনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালোই। আমাকেও জানাতে পারত। আপনারা গান্ধীজির ছবিটা মাটিতে রেখেছিলেন স্বাধীনতা দিবসে, আমরা কিন্তু রাখিনি। আমাদের কাছে তিনি হৃদয়ে বিরাজ করেন।
আমাদের ধরনা চলবেই। এভাবে আটকানো যাবে না। ওড়িশায় আমাদের কর্মীদের লাঠি দিয়ে মারা হয়েছে। অসমে বলছে বাঙালিরা ‘D = Doubtful’। সর্বত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাচার চলছে। আমরা অ-বাঙালিদের ওপর কোনও অত্যাচার চাই না, আমাদের সংস্কৃতিতে সেটা নেই। বাংলায় বেশি করে কথা বলুন। দেখি বিজেপি কতদূর যেতে চায়।
আগামীকাল দুপুর ২টো থেকে সমস্ত ব্লক, ওয়ার্ড আর জেলায় প্রতিবাদ মিছিল হবে বিজেপির আজকের কাজের বিরুদ্ধে। রানী রাসমণি রোডে নতুন ধরনার মঞ্চ তৈরি হবে। বৃষ্টির কারণে হয়তো কিছুটা দেরি হতে পারে। এখন থেকে প্রতিদিন এই আন্দোলন চলবে। কলকাতা পুরসভার এলাকায় মঞ্চ তৈরি হবে।
তারা কি কলকাতা পুলিশকে বা আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করেছিল? দলের সঙ্গে কথা বলেছিল? মঞ্চ একদিনে সরানো যায় না। আমার মোদী বাবুর অনুমতি লাগে না, আমি জনগণের অনুমতি নিই। আমি সেনাকে দোষ দেব না, তাঁরা দেশের জন্য কাজ করেন। মোদীজি এখানে এলেই কি আমাদের অনুমতি নেন? আমরাই সৌজন্যবশত অনুমতি দিই।
আমাদের কণ্ঠ বন্ধ করা যাবে না। একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বাঙালিদের উপর অত্যাচার যদি চলতেই থাকে, আমরা প্রতিদিন আন্দোলন করব। এটা আন্তর্জাতিক ভাষা। কীভাবে বলা যায় এই ভাষা নেই বা বাঙালিরা সন্দেহভাজন ভোটার?
আমি ইউনিফর্মকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেনাদের কাছে আমার আবেদন, নিরপেক্ষ থাকুন, কারণ আপনাদের সবাই ভালোবাসে। বিজেপির হাতের খেলনা হবেন না, নোংরা রাজনৈতিক খেলায় জড়াবেন না।
আমাকেও জানাতে পারত। ডুরান্ড কাপের সময় তো কত কথা হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রকের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ থাকে। সেনার কাজ মঞ্চ ভাঙা নয়, সেটা পুলিশের কাজ। স্থানীয় পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বিজেপির নির্দেশেই এটা করা হয়েছে। সেনার দোষ নেই, দোষ বিজেপির।
সেনার পোশাক অমূল্য। আমাদের পতাকা ও ব্যানার সরানোর অধিকার আপনারা পাননি। যদি মাতৃভাষাকে অসম্মান করেন, আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমি গণতান্ত্রিক আর রাজনৈতিক ভাবে লড়ব। সাংবাদিকদেরও সর্বত্র ওরা নির্যাতন করছে।