সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮
রাইসিং বেঙ্গল' কনক্লেভে কি বললেন মুখ্যমন্ত্রী - দেখে নিন এক নজরে

আজ একটি বেসরকারি চ্যানেলের ‘রাইসিং বেঙ্গল’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে সমাজের সকল স্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেন।
তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশঃ-
আমি আজ খুব গর্বের সঙ্গে বলছি, বাংলা এখন শুধু রাইসিং নয়, স্মাইলিংও। সব ক্ষেত্রে আমরা এক নম্বরে আছি। ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ আর ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ আমাদের মন্ত্র।
২০১৯ এর নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। ফেডেরাল ফ্রন্ট তৈরির জন্য অনেক দল একত্রিত হয়েছে। ২০১৯ জাতীয় রাজনীতিতে বড় ভূমিকা থাকবে। ‘২০১৯-এ গণভোট হবে’। শুধুমাত্র কংগ্রেস আর বিজেপি জাতীয় দল নয়, আমরাও জাতীয় দল।
মানুষের মনে দুটো আশঙ্কা আছে – আঞ্চলিক দলগুলি এক হলেও সরকার টিকে থাকবে কিনা এবং আদৌ কিছু কাজ হবে কিনা। এখন পরিস্থিতি বদলেছে, বেশীর ভাগ আঞ্চলিক দল জোটবেধে কাজ করছে।
২০১৯ এ গণভোটের হবে- মানুষ বিজেপিকে ভোট দেবে না, অন্যান্য দলকে দেবে। এর পিছনে অনেক কারণ আছে। মানুষ যদি একবার সরকার বদলানোর সিদ্ধান্ত নয়, টাকা, ভুয়ো খবর, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও তাদের টলাতে পারবে না।
আজকে মানুষ ভুগছে – সাধারণ মানুষ আজকের দিনে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। তারা পরিবর্তন চাইছে। তারা পরিবর্তনের জন্য দু’বার ভাববে না।
৩১% ভোট পেয়ে ২৮২টা আসনে জেতা কোনও ছোট ব্যাপার নয়। কিন্তু তা একবারই সম্ভব হয়। তারপর কি হল? অত্যাচার শুরু হল। পেট্রোলের দাম দিনে দিনে বাড়ছে। রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে। সবকিছুরই দাম বাড়ছে।
আমরা অনেক গণপিটুনির ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। এঙ্কাউন্টারের নামে মানুষ মারা হচ্ছে, কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠন এই কাজ করছে। আমরা চাই দেশ একজোট থাকুক এবং উন্নতি করুক।
যৌথ নেতৃত্ব কোথায়? আসলে তো মাত্র দু’জন মানুষ পুরো সরকারটা চালাচ্ছে। এই সরকার সর্বক্ষেত্রে ডাহা ফেল।
জাতীয় চ্যানেলগুলির প্রতি আমার অভিযোগ আছে। তারা কেন মুক দর্শকের ভুমিকা পালন করছে? তারা বিজেপির বিষয়ে কেন সত্যি কথা বলছে না? অধিকাংশ মানুষ এমনটাই মনে করে। কেন মিডিয়া বিজেপি-বান্ধব? গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল মিডিয়া। তবে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
ওরা শুধু রাজনৈতিক প্রচার চালায়। ওরা দেশের জন্য টাকা খরচ করবে না। এই নোটবন্দির সিদ্ধান্তটাই একটা উদাহরণ। এখন ৯৯% টাকা ব্যাঙ্কের কাছে ফিরে এসেছে। এটার কি দরকার ছিল? কালো টাকা সাদা করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল?
বিজেপি ভোটের জন্য জলের মতো টাকা খরচ করছে। বাস্তবটা আলাদা। আসলে ওরা টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চাইছে।
আমরা বিজেপির থেকে বেশী দেশভক্ত। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে কিছু জানে না। নাগরিকপঞ্জীর ইস্যুতে আমাদের দাবীকে বিকৃত করা হচ্ছে। আমরা বলেছি দেশের কোনও প্রকৃত নাগরিক যেন বাদ না পড়ে। প্রধানমন্ত্রী যদি শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন, তারা ভালো মুসলমান। তাদের নাম বাদ দিলে, তারা বাজে মুসলমান। সাদা ভালো আর কালো খারাপ?
যে ৪০ লাখ নাম নাগরিকপঞ্জীতে বাদ পড়েছে তার মধ্যে ২২ লাখ হিন্দু। আমাদের কি বিজেপি-র কাছ থেকে হিন্দু হওয়ার সার্টিফিকেট পেতে হবে? এই দেশটা মানুষের শরীরের মত, কোনও অঙ্গ বাদ গেলে সারা দেহ বাঁচতে পারবে না। আমরা এরকম বিভেদমূলক মতাদর্শে বিশ্বাস করি না।
আমরা বিজেপির কাছে উপদেশ চাই না। এটা স্বামী বিবেকানন্দের মাটি, এটা রবীন্দ্রনাথের মাটি, এটা রামকৃষ্ণের মাটি। আমরা তাদের বাণী মেনে চলি। এমনকি বল্লভ ভাই প্যাটেলের কথা বিকৃত করা হচ্ছে।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে হিন্দু ধর্ম সার্বজনীন। হিন্দু ধর্ম সহনশীল। আমরা সেই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করি। জঙ্গি হিন্দুত্বে নয়।
আমাদের দেশ কে ঐক্যবদ্ধ রাখতেই হবে। নয়তো ভারতের আর অস্তিত্ব থাকবে না।
আমরা বাংলায় ২৩ টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা প্রতিশালী। অনেকগুলি বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে আমাদের গাঁটছড়া আছে। শিক্ষা গ্রহণের জন্য অন্যান্য রাজ্যের অনেক শিক্ষার্থী বাংলায় আসছে।
কিছু লোক শুধু ভাষণ দেয় আর কিছু লোক কঠোর পরিশ্রম করে। কিছু মানুষ আছে যারা শুধুমাত্র ফেসবুকে ভাষণ দেয় আর কিছু ব্যক্তিরাও রয়েছে যাদের মধ্যে ডেডিকেশন, ডিভোশন, ডিসিপ্লিন আছে।
আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম তখন বাংলা অনেক পিছিয়ে ছিল। আমরা প্রতি বছর ঋণ শোধ করতে ৪৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করছি। তবুও, সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা এখন এক নম্বর। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা থেকে দক্ষতা উন্নয়ন, কন্যাশ্রী থেকে সবুজ সাথী – আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছি।
কেন্দ্রের একটা প্রকল্প আছে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ – তার বাজেট কত? কতজন মেয়ে উপকৃত হয়েছে? বাংলায় ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের জন্য আমরা ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ .করেছি, উপকৃত হয়েছে ৫০ লক্ষ মেয়ে। কেন্দ্র অধিকাংশ টাকা খরচ করছে শুধুমাত্র প্রমোশানের জন্য।
নীতিগত ভাবে আমরা বনধ বিরোধী। বাম্ফ্রন্টের শাসনকালে ৮০ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। তাই, যখন সারা দেশ ভারত বনধে স্তব্ধ ছিল, বাংলায় সবকিছু চালু ছিল। যদিও বনধ বিজেপির বিরুদ্ধে ছিল। আমরা নিজেদের মত প্রতিবাদ করেছি কিন্তু, বনধের বিরোধিতা করেছি ।
এই বছর আমার চীন যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে গেল। তারপরে শিকাগোর বেদান্ত সোসাইটি স্বামীজির বিখ্যাত শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকীতে আমায় একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ওরা আমায় এপ্রিল মাসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আর জুন মাসে লিখিত ভাবে জানাল যে ‘অনিবার্য কারণবশত’ অনুষ্ঠানটি হচ্ছে না।
বিদেশমন্ত্রক গতকাল একটা বিবৃতি দিয়ে বলেছে, আমরা শিকাগো সফরের জন্য অনুমতি চাইনি। যদি অনুষ্ঠানটি চূড়ান্তই না হয়, অনুমতির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আমরা জানি এই সময় শিকাগোতে আরএসএস-এর একটি অনুষ্ঠান ছিল। আমি এই জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সমর্থন করি না। আমার সফর শেষের পর ওরা ওদের প্রোগ্রাম করতে পারতো। কি ক্ষতি হল? অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে। অনেক মানসিক নির্যাতনও করা হয়েছিল।
প্রকৃত নাগরিকদের নাগরিকপঞ্জীর মূল তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত নয়। ২ কোটি লোকের মধ্যে ৪০ লাখ লোককে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? লিয়াকত-নেহেরু এবং ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি আছে। কেউ যদি বাংলায় কথা বলে তাহলে তাকে অনুপ্রবেশকারী তকমা দেওয়া সঠিক নয়। এমনকি বিহার, ইউপি ও তামিলনাড়ুর মানুষের নামও বাদ দেওয়া হয়েছে।
ওরা শিক্ষা ব্যবস্থা ধংস করতে চায়। গবেষণার জন্য খরচ বন্ধ করে দিয়েছে। দেশ কি করে এগোবে? শিক্ষাবীদরা সমস্যায় পড়ছেন। আমি জানি না এই বুদ্ধি তাদের কে দিচ্ছে?
বাংলা সারা দেশের মডেল। বিপুল দেনা ঘাড়ে নিয়ে আমরা সমস্ত সামাজিক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছি। সকল প্রকল্পের দেখাশোনা করার জন্য ব্লক স্তরে আমরা গত সাত বছরে আমরা ৪০০ বৈঠক করেছি।
এক্সাইস ডিউটি ইত্যাদি বাবদ কর নিচ্ছে। কিন্তু টাকা কত দিচ্ছে? কিছু না। রাজ্যরাই কিন্তু প্রকল্পগুলি চালায়।
কেন্দ্র আমাদের কোনরকম সহযোগিতা করে না। ওদের কাছে এটা রাজনৈতিক এজেন্ডা। আমি অনেক সরকার দেখেছি কিন্তু এরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার কখনো দেখিনি। যেভাবে ওরা সরকার চালাচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভুল।
আগে দিল্লি সামলা, তারপর দেখবি বাংলা। ২০১৯শে ওরা ২০০ আসনও পাবেনা। ওরা উত্তরপ্রদেশে হারবে, বিহারে হারবে, মহারাষ্ট্রে হারবে, মধ্য প্রদেশে হারবে, রাজস্থানে হারবে। শুধু তেলাঙ্গানাতেই ওরা সমর্থন পাবে।
বিজেপি যতই চেষ্টা করুক, এবার তারা জিতবে না। মানুষ চায় বিজেপি হারুক। কে প্রধানমন্ত্রী হবে তা পড়ে ঠিক করা যাবে। যৌথ নেতৃত্বে কাজ করবে সকলে।
সারাটা জীবন আমি সংগ্রাম করে এসেছি। এখন লড়াইটা অন্য। বাংলার আরও উন্নতি করতে হবে। আমার স্বপ্ন মানুষ যেন হাসি-খুশি ভাবে শান্তিতে এবং একতার সাথে জীবন যাপণ করতে পারে।
মানুষ আজ ভীত, সন্ত্রস্ত। তারা প্রধানমন্ত্রীকে ভয় পায়। কেউ কোনও রাজনৈতিক দলকে পছন্দ বা অপছন্দ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ভয় পেতে হবে? কেউ মুখ খুললেই সিবিআই, ইডি চলে আসবে।
রাজনৈতিক দলগুলিকে জঙ্গি মনোভাব, বিভেদের রাজনীতি বা মৌলবাদ থেকে বিরত থাকা উচিত। ভারত একটি বৈচিত্র্যময়, বিশাল দেশ। বৈচিত্র্যর মধ্যে একতাই গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৪ সালে বিজেপি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কালো টাকা ফিরে আসবে, ১৫ লক্ষ টাকা সবার ব্যাঙ্ক আকাউন্টে চলে আসবে, ইত্যাদি। কটা প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে? ২০১৯শে মানুষ আর প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করবেন না।