September 28, 2017
জন বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ মমতাই

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সর্বোপরি অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে। যে প্রত্যাশা এবং সম্ভাবনার কথা বারবার করে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপনা করেছে তাঁর অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত ফলদায়ক হয়ে উঠছে না। মানুষের বহু অভাব, অভিযোগকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে কোনভাবেই যে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার ইঙ্গিত দিতে পেরেছে, তাঁর কোনও নজির এই ঘোষণার মধ্যে নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পেশ করা সর্বশেষ রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল তড়িঘড়ি, একতরফা এবং পরিকল্পনাহীন। ঠিক অনুরূপভাবে মহা সমারোহে ৩০ জুন রাত বারোটায় লোকসভার বিশেষ অধিবেশনে আহ্বান করে যে জিএসটি প্রণয়নের কথা ঘোষিত হয়েছিল তাতে দেশের মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যারপরনাই অস্বস্তিতে পড়েছেন। সাধারণ মানুষও নিজেদের জিএসটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সড়োগড়ো করে তোলা তো দূরের কথা, এ বিষয়ে তাদের সম্যক কথা ধ্যানধারণা পর্যন্ত এখনও পরিষ্কার হতে পারছে না। জিএসটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন অনেক পদক্ষেপ, এমন অনেক সামগ্রির প্রতি বলবৎ করা হয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়েই এই সমস্ত কর্মসূচীগুলির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলগুলির প্রতি উপেক্ষা এবং সর্বোপরি নানাবিধ উপায়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে নানা প্রক্রিয়ায় হেনস্থা করার ন্যক্কারজনক এবং ঘৃণ্য মনোভাবও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে অত্যাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য শাসকদল বিরোধী দলগুলির প্রতি যে মনোভাব পোষণ করছে তা কাম্য নয় এবং ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে খারাপ নজির স্থাপন করছে। দেশে এই মুহূর্তে সব চাইতে বড় বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেস দলের সদস্য সংখ্যা ৪৪। দ্বিতীয় স্থানে আছে এআইডিএমকে। যারা প্রকৃত অর্থে বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে না। কারণ এদেরই দলনেতা লোকসভার ডেপুটি স্পিকার। এআইডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা প্রয়াত হওয়ার পর লোকসভার অন্দরে বিরোধিতার সুর এরা সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলেছে।
তৃতীয় দল হিসাবে, দেশের সর্বাধিক সোচ্চার বিরোধী দল হিসাবে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস তাঁর দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করছে। দেশের বিরোধী দলগুলিকে সংগঠিত করা, ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে তৃণমূল কংগ্রেস শুরু করেছিল তা আজও বাস্তবায়ন করতে এবং এই চিন্তাধারাকে সফল করে তুলতে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল শক্তিশালী হলে তবেই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এই উপলব্ধি বোধ বর্তমান শাসক দল বিজেপির মধ্যে বিন্দুমাত্র নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে বিরোধী দলগুলির গঠনমূলক প্রস্তাব কখনও কোনও ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। এরপরেও আমাদের অর্থনীতিতে অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় বিলগ্নীকরণ বা ডিসইনভেস্টমেন্ট ইন পাবলিক সেক্টর। এখন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার মত প্রতিষ্ঠানকে বিলগ্নীকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নেতৃত্বে কমিটি তৈরি হয়েছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয় নিয়ে শুধু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করা নয়, এই নিয়ে সাংসদের দিল্লিতে দরবার করার জন্য এবং এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে সংসদীয় দলকে নির্দেশও দিয়েছে। লাভজনক না হলেও দেশের সম্মানকে, মর্যাদাকে যারা কোনও না কোনও সময় অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন সেইরকম একটি প্রতিষ্ঠানের নাম এয়ার ইন্ডিয়া। যার মহারাজা প্রতীক আজও বিশ্বের মানুষের কাছে একটি চেনা মুখ। কাদের কথা, কিসের উদ্দেশ্যে কেন বিভিন্ন সরকারি, সরকারের অধীনস্থ সংস্থাগুলিকে বিলগ্নীকরণের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তা বিস্তারিতভাবে লোকসভাতেও আলোচনা হচ্ছে না।
তৃণমূল কংগ্রেস একটি আঞ্চলিক দল হলেও সর্বভারতীয় ভিত্তিতে স্বীকৃতি লাভ হয়েছে। নোট বাতিলের সময় আরও কিছুটা ধীরে চলার নীতি, জিএসটি প্রয়োগের সময় আরও কিছুটা ধীরে চলার নীতি, বিলগ্নীকরণের ক্ষেত্রে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পথ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপূরক। কিন্তু বর্তমান সরকার এক অদ্ভুত গোয়ার্তুমি মনোভাব নিয়ে শুধু নিজেদের মধ্যে আপোসে, আলোচনার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করেছে তাতে আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির পক্ষে বড় বিপর্যয় ঘটার ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় সারা দেশের বিরোধী দলগুলির কাছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনাকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের মধ্যে বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলির প্রতি যে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হচ্ছে তা কল্পনাতীত। দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর থেকেই ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল বরাবরই ব্বঞ্চিত থেকে গিয়েছে। বঞ্চনার শিকার হয়েছে বাংলা-বিহার-অসম-ওড়িশা-ত্রিপুরা। বঞ্চনার অভিযোগ আজ আরও বেশি করে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীদের আহুত বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, তামিলনাড়ু,র মুখ্যমন্ত্রীরা সঠিকভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্য যে সময় প্রয়োজন সে সময়টুকুও তাঁরা বৈঠকে পাচ্ছেন না। ঘণ্টি বেজে উঠছে বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই। মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বক্তব্য পেশ করতে হচ্ছে লিখিত আকারে। রাজ্যগুলিকে রাজ্যের মতো তাঁর সীমানার মধ্যে কাজ করতে দিলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরোধিতার ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসে। কেদ্রের সরকার তার এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে তাদের সরকার চালাবে। আর রাজ্যের নির্বাচিত সরকারগুলিকেও নিজেদের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। এটাই তো প্রত্যাশিত। এতে বিরোধিতার ক্ষেত্র যেমন কম আসে তেমনই গণতান্ত্রিক কাঠামোর নিয়মকেও যথার্থ মর্যাদা এবং স্বীকৃতি দেওয়া যায়। আমাদের দেশে বর্তমানে যারা সরকার পরিচালনা করছেন তারা শতকরা ৩১ ভাগ ভোট পেয়ে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। ঠিকই, কিন্তু শতকরা ৬৯ ভাগ মানুষ এই সরকারকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সমর্থন জানাননি। তা নির্বাচন কমিশনের তথ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। ভারতবর্ষের সীমানায় আজ অস্থিরতা , অর্থনীতিতে অস্থিরতা, সম্প্রীতি রক্ষায় অস্থিরতা, গো রক্ষার নামে অস্থিরতা। সবমিলিয়ে এই অস্থিরতার নিরসন হওয়া প্রয়োজন। আমরা মনেপ্রাণে এই প্রত্যাশাই করব যে বহুকষ্টে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা এবং পরবর্তীকালে সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৩০ কোটির দেশে সঠিকভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যায়নের যথার্থ প্রতিফলনে রাজ্যগুলিও যেমন কেন্দ্রের সঙ্গে অযথা বিরোধিতার ক্ষেত্র প্রশস্ত করবেন না। তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারকেও রাজ্য সরকারগুলির প্রতি স্বাধিনভাবে নিশ্চিন্ত হতে হবে। তারা যেন কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে যেন সম্পূর্ণ সহায়তা দেয়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গলা টিপে, টুটি টিপে হত্যা করার কোন প্রবণতা এই দেশের মানুষ কখনই গ্রহণ করবেন না। সংহতি, সম্প্রীতি এবং ঐক্যের বাতাবরণেই ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক সমৃদ্ধশালী। আর এ বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের পদক্ষেপ, মনোভাব, মানসিকতা বর্তমান সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে যথার্থ ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আগামীদিন সারা দেশের মানুষের কাছে সেই তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখই হয়ে উঠবে মানুষের মুক্তির মুখ। আর সেই দিনের প্রত্যাশাই আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন , আরও দায়িত্বশীল, আরও কর্তব্যপরায়ণ করে তুলবে। আমাদের বিশ্বাস ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশবাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মারফত যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে তার সাফল্য আজ হোক, কাল হোক অনতিবিলম্বে মিলবে।