সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্তমান ষোড়শ লোকসভাতে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় হয়েছে সর্বত্র। ষোড়শ লোকসভার যখন প্রথম অধিবেশন শুরু হয়, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তখন তৃণমূল কংগ্রেস মুখ্য বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে লোকসভাকে উজ্জীবিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
মনে রাখতে হবে জাতীয় কংগ্রেসের মতো দল যেখানে মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছে, যেখানে ভারতবর্ষের সংসদে কোনও স্বীকৃত বিরোধী দল নেই, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসকে তাঁর ৩৪ জন সাংসদকে নিয়ে বিরোধী দলের দায়িত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে সমস্তরকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছিল।
লোকসভা অধিবেশনের আগে আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস ভারতবর্ষে ষোড়শ লোকসভাতে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা তৃতীয় হতে পারিনি। কিন্তু আমরা চতুর্থ হয়েছি। তৃতীয় হতে পারতাম, যদি তামিলনাড়ু রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে সমস্ত আসনেই এআইএডিএমকে জয়ী না হত। ডিএমকে যদি পাঁচটি আসনও পেত, তাহলেই তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় শক্তি হতে পারত। এআইএডিএমকে ৩৭টি আসন পেয়ে সেখানে তৃতীয় হয়েছে। এবং যে মায়াবতীর দল পঞ্চদশ লোকসভাতে তৃতীয় বৃহত্তম দল ছিল, তারা এবার লোকসভাতে শূন্য হয়ে গিয়েছে। সমাজবাদী পার্টি মুলায়ম সিংইয়ের নেতৃত্বে, জনতা দল ইউনাইটেড শরদ যাদবের নেতৃত্বে যারা লোকসভাতে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করত, তাঁদের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। আমরা সে কারণে সারা দেশের বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করার ভূমিকা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক সাফল্যের সঙ্গে সারা দেশের প্রচারমাধ্যমের কাছে আমাদের দক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের দলের বক্তারা যে বক্তব্য সেখানে পেশ করেন, তা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পায়। সৌগত রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্না দে নাগ, সুলতান আহমেদ এবং দীনেশ ত্রিবেদী এঁরা প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু বিষয় উত্থাপন করতেন। সংসদ পরিচালনা করতে গেলে আইন সংক্রান্ত নিয়মাবলি সংক্রান্ত রুলস বুককে অনুসরণ করে সভা কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসই লোকসভাকে দিক নির্দেশ করে। ের জন্য স্পিকার মহোদয়া সুমিত্রা মহাজন পর্যন্ত একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন না।
ইউপিএ সরকারের আমলেো আমরা জমি অধিগ্রহন বিলের বিরোধিতা করেছিলাম। তখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম। আবার এনডিএ সরকারের আমলেও জমি বিলের বিরোধিতা করেছি। কংগ্রেস এবং বিজেপি একসঙ্গে ড. মনমোহন সিং সরকারের আনা জমি বিলের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল। সেখানে বিরোধিতায় ভোট পড়েছিল ১৯। আর আমাদের সংসদ সদস্য সংখ্যা ছিল ১৯। তৃণমূল কংগ্রেস ভারতবর্ষে একমাত্র দল পরিপূর্ণভাবে যারা একটা ঘোষিত নীতি নিয়ে জমি বিলের বিরোধিতা থেকে একচুলও নড়ে বসেনি। এবং কৃষকের জমি বলপূর্বক অধিগ্রহণ করা যাবে না।, এই নীতিতে বরাবর অবিচল থেকেছে। আবার যখন দেশের স্বার্থে জিএসটি বিল উপস্থাপিত করা হয়েছে, তখন রাজ্যের স্বার্থে অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ উপকৃত হতে পারে সে কোথা মাথায় রেখে এই বিলকে সমর্থন জানাতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করিনি। আবার আমরা সংসদীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালনায় ফেডারেল স্ট্রাকচারের পক্ষপাতী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে রাজ্য সরকারগুলির বিভিন্ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে আমরা তার তীব্র বিরোধিতা করছি।
ভারতবর্ষ হচ্ছে বহু রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। এখানে কেন্দ্রকে রাজ্যের উপর নির্ভর করতে হয়, রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু আমরা আশ্চর্যের সাথে লক্ষ করছি পশ্চিমবঙ্গের প্রতি ভয়ানকভাবে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চনা করা হচ্ছে। আমরা এটা হতে দেব না। বিহারের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে। কারণ বিহারে নির্বাচন আসছে। আমরা তাঁর বিরোধী নই। বিহারও পুর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য। কিন্তু এত বড় ভয়ানক বন্যা। ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি ঋণের বোঝা বাংলার সরকারের কাঁধে। তাঁদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করতে কিসের এত দ্বিধা, কুণ্ঠা। কেন এত বড় বন্যার পর এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা এসে পৌঁছল না এর জবাব দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। আবার যখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজন পড়ছে, তখন? বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের সীমান্তচুক্তির জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানে উপস্থিত না করাতে পারলে এই চুক্তি সম্ভব হবে না, একথা কেন্দ্র অনুভব করেছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বুঝিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদ্র রাজনীতির সীমানা এবং গণ্ডিকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারাবার তাঁকে স্নেহের সঙ্গে আলিঙ্গন করে নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন।
লোকসভার এই শীতকালীন অধিবেশনে আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি, একটা দিনের জন্যও লোকসভার অধিবেশন সুষ্ঠুভাবে হতে পারল না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কিছু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ বিরোধীরা এনেছিলেন। সেই আলোচনা যদি লোকসভাতে প্রথম দিনই করে দেওয়া যেত, তা হলে নিশ্চয়ই এই পরিবেশের সৃষ্টি হত না। সে আলোচনা হল। কিন্তু বিলম্বে হল। এর মাধ্যমে এটাই বোঝা গেল বর্তমান শাসক দলের লোকসভা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যে দক্ষতা থাকা উচিত, সেই দক্ষতার ছাপ তারা রাখতে পারেনি। এবং সর্বাধিক আশ্চর্যের বিষয় দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় একমাসব্যাপী পরিচালিত লোকসভার অধিবেশনের মধ্যে তিনদিনও উপস্থিত ছিলেন না। বিদেশ থেকে কালো টাকা আনার প্রশ্নে আমরা একথা বারবার বলেছিলাম, লোকসভার বাইরে প্রধান ফটকের সামনে গান্ধীমূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে বারাবার করে দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। স্লোগান তুলেছি-‘কালা ধন বাপাস লাও’। আমরা বলেছি, কৃষককে বঞ্চনা করা যাবে না। লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদিজি ঘোষণা করেছিলেন যে, প্যান নম্বর আর ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট থাকলে, সব অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ করে টাকা তিনি জমা করিয়ে দেবেন। পনেরো লক্ষ টাকা দূরের কথা, একটা টাকা পর্যন্ত কোনও অ্যাকাউন্টে অতিরিক্ত জমা পড়েনি। মানুষকে এইভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কালো টাকার যারা মালিক, কালো টাকার পাহাড়ে যারা বসে আছেন, আজকে তারাই ভারত সরকার পরিচালনা করছেন।
অপরদিকে কংগ্রেসের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায় লোকসভাকে স্থগিত করে দেওয়ার যে প্রয়াস এবার চলেছে, তা জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কংগ্রেসের পঁচিশজন সাংসদকে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া সমীচীন সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। স্পিকার আমাকে তার আসন থেকে বলেন, আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। এঁরা নির্ধারিত কর্মসূচী মেনে লোকসভা চলতে দিতে যদি রাজি থাকেন, তাহলে আমি সাসপেনশন প্রত্যাহার করব। আমি অন রেকর্ড লোকসভায় দাঁড়িয়ে স্পিকারকে বলি যে, আমি আমার দলের দায়িত্ব নিতে পারি। আমাদের সাংসদরা বিরোধী দলের ঐক্যকে বজায় রাখতে পাঁচদিন লোকসভার অধিবেশনে যোগদান করেননি। উপরন্তু কংগ্রেস যখন গান্ধী মূর্তির সামনে ধরনা দিয়েছে, তখন রাহুল গান্ধী এবং জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া আমার কাছে সমর্থন চান। আমি ত९ক্ষণা९ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে অনুমতি দেন যে, “হ্যাঁ, আপনার নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধি দল ওদের ধরনায় গিয়ে অংশগ্রহন করে নৈতিক সমর্থন দিয়ে আসুন”। লোকসভা চলাকালীন প্রতিনিয়ত সোনিয়া গান্ধী আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। আবার সরকারের পকশ থেকেও মাঝেমধ্যে আমাদের সমর্থন চাওয়া হয় সরকারী বিলকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমরা আমাদের ভূমিকা অকপটে সব পক্ষকেই জানিয়ে দিই যে, তৃণমূল কংগ্রেস একটি এমন দল যার নিজস্ব মতাদর্শ আছে। যার নিজস্ব অর্থনৈতিক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে। তার পটভূমিতেই আমরা সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করি। জনস্বার্থ-বিরোধী কোনও সিদ্ধান্তকে আমরা অনুমোদন দেব না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্যের তালিকার মধ্যে নিয়ে আসা। সেই পথ ধরে তিনি এগোচ্ছেন। নির্বাচনী ইস্তাহারে দেওয়া সমস্ত ঘোষণা তিনি তিন বছরের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ পূর্ন করেছেন। বিরোধী দলগুলির প্রত্যাশিত মর্যাদা যেখানে যেভাবে দেওয়া দরকার, এ রাজ্যে তিনি তা দিয়েছেন। কিন্তু লোকসভাতে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। এর ফলে ভারতবর্ষের প্রথম কন্সটিটিউশন ক্লাবে বিশাল হল ঘর নিয়ে আমাদের নকল লোকসভার অধিবেশন করতে হয়েছিল। একদিকে সরকার পক্ষ, একদিকে বিরোধী পক্ষ। সরকার পক্ষে আমাদের তিনজন রাজ্যসভার সাংসদ ছাড়াও দিল্লির একটি স্থানীয় স্কুলের অত্যন্ত কৃতী ছাত্রছাত্রীদের তালিম দিয়ে সদস্য করে বসানো হয়েছিল। বিরোধী দলে আমরা ছিলাম। স্পিকারের আসন, সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা, সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষ, মার্শালের ভূমিকা- সব কিছু সুন্দরভাবে সেদিন তুলে ধরা হয়েছিল। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে সেদিন আলোচনা করি। একটা জমি বিল, আর একটা কো-অপারেটিভ ফেডারালিজম- এর উপর আলোচনা হয়। জিরো আওয়ার হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব হয়। এবং সমস্ত অধিবেশনটি এত সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছিল যে, এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী শুধু তার সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তাই নয়, আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, “এত ভাল কর্মসুচি আপনারা করেছেন যে, আমি আপনাদের একটা আলাদা করে রাতে সুন্দর করে খাইয়ে দেব”। আমরা এতে অত্যন্ত আনন্দিত এবং খুশি হয়েছিলাম।
সবশেষে বলি তৃণমূল কংগ্রেস আজকে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত, দক্ষ, চিন্তাশীল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দল হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করতে পেরেছে। লোকসভার অভ্যন্তরে তৃণমূল কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কি সরকার পক্ষ, কি বিরোধী পক্ষ তারা কোনও বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতেও যেখানে সক্ষম না, সেখানে আমারা এই বিশ্বাস রাখি যে, আমাদের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিদারুণ প্রচেষ্টায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকারকে পশ্চিমবঙ্গে মানুষের সমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তাঁর চিন্তাধারার প্রতিফলন লোকসভায় আমরা যেভাবে প্রতিফলিত করেছি তাতে দেশের মানুষ আগামিদিনে আমাদের প্রতি আরও আস্থা, আরও বিশ্বাস রাখবে। এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাংলার কণ্ঠস্বরকে কোনও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়েই হোক, কোনওরকম ভুয়া প্রতিশ্রুতির কথা বলেই হোক, আমাদের পথ থেকে আমাদের কেউ হঠাতে সক্ষম হবে না। আগামীদিন তৃণমূল কংগ্রেস আঞ্চলিক দলের সীমানা অতিক্রম করে কোনও একদিন জাতীয় দলে রূপান্তরিত হবে এই বিশ্বাস আমি রাখি