উন্নয়ন ও দায়িত্ব-কর্তব্য

দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাংলায় পরিবর্তন এসেছিল। জনতার সমুদ্রে ভর দিয়ে জননেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলায় এক নতুন সূর্য উঠেছিল সেদিন। আর এই সূর্যোদয়ের পেছনে ছিল কয়েক হাজার তৃনমূল নেতা- কর্মীর আত্মবলিদান।

গনতন্ত্রের পথ ধরে যে বাংলা সেদিন নেত্রী হাতে পেয়েছিলেন তা ছিল পুরোপুরি নিঃস্ব-রিক্ত। ৩৪ বছরের অনুন্নয়নের ধাক্কায়  ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল বাংলার স্বপ্ন। প্রায় ২ কোটি বেকার, কেন্দ্রের ঘরে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ রেখে বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছিল বামফ্রন্ট। কোষাগার ছিল পুরোপুরি শুন্য।ঠিকাদাররাজ, দালালরাজ থেকে শুরু করে বেআইনি কর্মকান্ডের গর্ভগৃহ হয়ে উঠেছিল সরকারি অফিসগুলি। দিনের শেষে সরকারি দফতরে মিছিল-আন্দোলন কর্মসূচি পাওনা ছিল রাজ্যবাসীর। অধিকাংশ কারখানার গেটে তখন তালা ঝুলছে, শ্রমিক-মহল্লায় হাহাকার। গরিব কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্পপতিদের কার্যত জলের দরে দিয়ে দিয়েছিল আলিমুদ্দিনের শাসকরা। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির বিষবাষ্প সুকোলমতি পড়ুয়াদের মেধা-বুদ্ধি-বৃত্তিকে পুরোপুরি অকেজো করে দিয়েছিল। উন্নয়ন ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র ভোট লুঠ করে ক্ষমতায় বসেছিলেন চেচেস্কুর উত্তরসূরিরা।

সিঙ্গুর, নন্দিগ্রাম শুধু নয়, নেতাইয়ের মতো কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়ে একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল সিপিএম নেতারা। জমি বাঁচাতে গিয়ে তাপসী মালিকের মতো অনেক নারীর সম্ভ্রমের পাশাপাশি প্রাণও গিয়েছে। কয়েক ডজন শিশু-কিশোর হারিয়ে গিয়েছে নন্দীগ্রামের লড়াইয়ের সাক্ষী হলদি নদীর জলে।সেদিনের স্মৃতি মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠতে হয়। নেত্রীর নির্দেশে আমাদের মতো সৈনিকরা তখন দিনরাত এক করে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জুলুমবাজির সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলাম। এই দীর্ঘ সংগ্রামে বেশ কয়েকবার নেত্রীর জীবন বিপন্ন হয়েছে। কোনওক্রমে প্রানে বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের সকলের প্রিয় জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুরের বিডিও অফিসে রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে দিয়ে পুলিশের রাইফেলের কুঁদো দিয়ে গুঁতিয়ে নেত্রীকের হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বাম সরকারের পুলিশ। যত তাঁর উপর আঘাত এসেছে ততই আরও জোরদার আন্দোলন করে মানুষের দাবিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন।

এভাবেই একদিন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের বেদিমূলে অর্ঘ্য দিয়ে সরকারে পৌঁছে দিয়েছেন জননেত্রী। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই মহাকরণে বসে দেখতে পেয়েছেন বাম জমানার রেখে যাওয়া প্রশাসনে তখন শুধুই দলবাজি। কর্মসংস্কৃতির পুরোপুরি বিসর্জন হয়ে গিয়েছে রাজনীতির গঙ্গায়। পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের পরিবর্তে লাল পার্টির নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে ওঠাবসা করেছিলেন।মানুষের উপকার দুরের কথা নুন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়েচগিলেন প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বরা। সব মিলিয়ে সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভয়াবহ- ভগ্নদশা অবস্থায় বাংলাকে পেয়েছিলেন তা বোধ করি বিশবের অন্য কোনও প্রশাসক পেলে দায়িত্ব নিতেন না। কিন্তু মানুষের উন্নয়নে ২৪ ঘন্টা কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ অগ্নিকন্যা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর এই দায়িত্ব তাঁকে যে বিশবসভায় বাংলাকে পৌঁছে দেওয়ার শপথ নিতে সাহায্য করেছে তাঁর প্রমাণ কন্যাশ্রী এখন বিশ্বশ্রী। গর্বিত বাংলা,গর্বিত আমি তাঁর সরকারের একজন সহকর্মী হয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে। অবশ্যই গর্বিত বাংলার তৃনমূল কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীরা, যারা সরকারের নানা প্রকল্প ও পরিষেবাকে জনতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। জেলায় জেলায় নানা চক্রান্ত ও বিরোধিদের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত সমস্ত প্রকল্প এবং পরিষেবা সাধারণ মানুষের জন্য বাস্তবায়িত করে চলেছেন।

কিন্তু কেন তিনি এমন একটা সবদিক থেকে দেউলিয়া সরকারের দায়িত্ব নিলেন? কীভাবে ও কোন পথে কেন্দ্রীয় সরকারের লাগাতার বঞ্চনা এবং পক্ষপাতিত্ব উপেক্ষা করে এভাবে বিপুল উন্নয়নে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন? বিদেশের প্রতিনিধিরা যখন কলকাতায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন সকলেরই এই দুটি প্রশ্ন অবধারিত করে থাকেন। দিন কয়েক আগে কলকাতার মার্কিন দুতাবাসের এক শীর্ষ আধিকারিক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মাত্র তিন মিনিটে রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কীভাবে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার শীর্ষকর্তারা কলকাতায় এসে অবাক বিস্ময়ে অনুসন্ধান করেছেন কোন জাদুমন্ত্র বলে ন্যায্যমূল্যের দোকানে এত বিপুল ছাড় দিয়ে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। বলতে পারেন, এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিরাকেল। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ভাবনী শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কেউ যে পারবে না, তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন দেশ- বিদেশের নানা সামাজিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা।

বাংলার প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে জননেত্রী দেখেছিলেন সামাজিক প্রকল্প ও পরিষাবার ক্ষেত্রে বিপুল শুন্যতা। রেশন দোকানের নাম করে যে সমস্ত ডিলাররা চাল-গম সংগ্রহ করতেন,তাঁর অধিকাংশই গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছাত না। গড়িব মানুষের নাম করে সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুরপথে পৌঁছে যেত সিপীম-এর পার্টি অফিসগুলিতে। স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের একটা বড় অংশই শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির ক্রিড়াঙ্গনে পরিনত করেছিলেন। মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না এলেও বেতন নিয়ে চলে যেতেন একদল রাজনীতি-সর্বসব লালপার্টির নেতারা। হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতে এসে দালালচক্রের হাতে সমস্ত খুইয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এমন অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক সামাজিক প্রকল্প চালু করার পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেন।

এতদিন বাংলার মানুষ জানতেন যে মুখ্যমন্ত্রী মানে মহাকরণের অলিন্দে থাকা একটা ক্ষমতাশালী মানুষ। স্বাধীনতার পর কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতি মাসে জেলায় জেলায় ঘুরে উন্নয়ন নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক করেছেন, এমন নজির শুধু দেশ কেন, গোটা বিশ্বে নেই। অথচ তৃনমূল নেত্রী গত ছ’বছরের বেশি সময় সেটাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর প্রথম সফর ছিল জঙ্গলমহল। এরপর পাহাড়, সুন্দরবন সর্বত্রই ঘুরে ঘুরে সরেজমিনে উন্নয়নের নানা প্রকল্পের বাস্তবায়নের দেখেছেন তিনি। পরখ করেছেন প্রতিট প্রকল্পের সরকারি ব্যয়ের খুঁটিনাটি। আসলে জনগণের প্রতিটি পাইপয়সার হিসাব অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দেখে রাখতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত এই কারণে তিনি প্রায়ই বলেন “আমি জনগণের পাহারাদার।” শুধু উন্নয়ন নয়, দুর্গাপুজো থেকে মহরম, ইদ থেকে বড়দিন, নববর্ষ থেকে নিউইয়ার, উৎসবে যখন বাংলার কোটি কোটি মানুষ মগ্ণ থাকেন, তখন প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে কড়া নজরদারি চালিয়ে যান জনতার নেত্রী।

অশান্তির ঘুর্ণিঝড় বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল জঙ্গলমহল। ফেরালেন শান্তি। সঙ্গে সঙ্গে বিপথে যাওয়া জঙ্গলমহলের যুবকদের জীবনে এনে দিলেন কর্মসংস্থানের অক্সিজেন। এখানেই শেষ নয়, সমস্ত আদিবাসীদের জন্য দু’টাকা কিলো চাল-আটা চালু করলেন। সবুজ সাথী সাইকেল থেকে শুরু করে কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, মাতাশ্রী-র মতো নানা প্রকল্প আজ শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশেই বিভিন্ন রাজ্য অনুকরণ করছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প শুধুমাত্র নারীশিক্ষায় আলো আনেনি, বাল্যবিবাহ থেকে শুরু করে নারী পাচার অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছে আমাদের রাজ্যে। আর সেই কারণেই রাষ্ট্রসংঘ কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রবক্তা বাংলার নবরুপকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বিশ্বসম্মান তুলে দিয়েছে। বাংলা হয়েছে সত্যি সত্যি বিশ্ববাংলা।

দেশের এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে আমাদের। সামাজিক সম্প্রীতি আজ মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। দেশে চরম অসহিষ্ণুতা গ্রাস করতে চলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর কাছে একটাই মরূদ্যান- বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লি থেকে পাটনা, সর্বত্রই তাঁকে সামনে রেখেই দেশের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ নিচ্ছেন। স্বভাবতই বাংলার তৃনমূল কর্মীদের দায়িত্ব পড়েছে মা-মাটি-মানুষের নেত্রীর উপর। তাই একদিকে যেমন নেত্রীর চালু করা সমসত প্রকল্প ও পরিষেবা আরও বেশি করে জনতার কাছে পৌঁছে দিতে হবে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী লড়াইকে আরও জোরদার করতে হবে। দলকে করতে হবে আরও শক্তিশালী। দলীয় কর্মিদের মনে রাখতে হবে, দলীয় সংগঠন যত শক্তিশালী হবে, নেত্রীর হাত ততই মজবুত হবে। আর দেশের নেতৃত্ব দিতে আরও সহজ এবং সাবলীল পথ হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় নেত্রীর। মনে রাখতে হবে, সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন মা-মাটি মানুষের নেত্রীর হাত ধরেই বিভাজনের রাজনীতিকে গুড়িয়ে দিয়ে দেশে মুক্তির নতুন সূর্য উঠবে। নতুন ভারত গড়ে উঠবে, স্বপ্ন সফল হবে মা-মাটি মানুষের।