October 9, 2016
রোম -জার্মানির রেডারে বাংলা – মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

২ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর সকাল। আটটি দিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বক্ষণের সফরসঙ্গী হিসেবে আমার থাকার সুযোগ ঘটেছিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে এমিরেটসের বিমানে কলকাতা-দুবাই প্রথমে পৌঁছনো হয়। সেখানে আমরা একত্রে ছিলাম। মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, সস্ত্রীক মুখ্যমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি গৌতম সান্যাল, রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। সঙ্গে ছিল একদল সাংবাদিক বারো সংখ্যায়।
আমরা দুবাই বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর হাই কমিশনের পক্ষ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানানো হয়। তাঁকে আলাদা করে সেরিমনিয়াল লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রদূত স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত প্রতিনিধিকে একত্রিত করে একটি বাসে করে আমরা উপস্থিত হই। কিছুক্ষনের মধ্যেই খবর আসে ভারতবর্ষের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ খুব নিকটে সেরিমোনিয়াল লাউঞ্জে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষা९ করতে চান। তারপর সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংলগ্ন একটি বিরাট কক্ষে যেখানে সুষমা স্বরাজ নয় সদস্যের এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন। দিল্লি থেকে এসে তাঁরাও একই সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের যাত্রা ছিল ৪ সেপ্টেম্বর রোমের ভ্যাটিকান শহরে মাদার টেরিজার সন্তায়ন আখ্যায় আখ্যায়িত করার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। সুষমা স্বরাজ এবং তাঁর সঙ্গে আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যে সাংসদরা প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন তাঁরা সকলে মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে উচ্ছসিত হন। দীর্ঘ ৪৫ মিনিট কথোপকথন। আলাপ-চারিতা হয়। প্রতিনিধি দলে জনৈক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও ছিলেন। সেখান থেকে একই বিমানে আমরা সকলে মিলে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
ইউরোপের বুকে ভারতের এক বড় প্রতিনিধি দল পৌঁছেছে। আরও ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি কলকাতা শহর রোমে উঠে আসছে। ২ তারিখে সময়সূচিতে রাত্রি হয়ে যাওয়ায় সকলে যে যাঁর মতো নৈশভোজ সেরে ঘরে চলে যায়। ৩ তারিখ সকালে যখন আমরা সকলে প্রাতরাশের ঘরে আলোচনা করছি, নিজেরা একবার ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পরিবেশটা একবার দেখে আসা যায় কখন। তখন দেখি হোটেল থেকে দু’কিলোমিটার দূরে ভ্যাটিকান সিটি চার্চ পরিভ্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে আসছেন। তাঁর এই ততপরতায় আমরা যুগপ९ বিস্মিত হয়ে পড়েছি। এর আগেইতালিও দূতাবাসের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দফতর থেকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যান্য প্রতিনিধিদের ঘর বরাদ্দ নিয়ে এক অন্যায় এবং অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু বিদেশের মাটিতে দেশের রাষ্ট্রদূতভবনের এই অন্যায় কার্যকলাপ মেনে নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী প্রচুর ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে বরাদ্দকৃত ঘরেই অবস্থান করেন। যে ঘরে তাঁকে স্থান দেওয়া হয়েছিল তা দেখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল যিনি ওই হোটেলে ছিলেন, তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমার ঘরের থেকে এই ঘর ছোট শুধু তাই নয়, একই ঘরের সঙ্গে যেখানে শোয়া এবং বাথরুম যেভাবে মুখোমুখি সংলগ্ন।
এমনকী , যেভাবে ঘরে বসার অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেই তা দেখে আমি বিস্মিত।কিন্তু যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী এসব বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না তাঁর নিজের জীবন নির্বাহের মধ্যে দিয়ে বারবার প্রমান করেছেন। তাই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন চার তারিখের কর্মসূচীতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানকে সারা বিশ্বব্যাপী মানুষের সামনে কীভাবে তুলে ধরবেন।
ওই দিনই বিকেলে হোটেলের লনে আমরা গোল হয়ে বসলাম। মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব দিলেন হোটেল থেকে ভ্যাটিকান সিটি উ९সবস্থল পর্যন্ত আমরা একত্রে গান গাইতে গাইতে যাব। প্রথমে বিষয়টি শুনে অনেকে ভ্রুকুঞ্চন করেছিল। ইটা কি আদৌ বাস্তবে সম্ভব। শুরু হলো গান বাছাইয়ের পর্ব। একটি, দুটি করে চারটি গান বাছা হল। শুরু হল রিহার্সাল। নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা কখনো গান গাননি তাঁদেরও দেখা গেল ঠোঁট নাড়তে। গানের নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরেই রিহার্সাল শুরু হয়। ততক্ষনে হোটেলে আসা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা অধীর আগ্রহে আমাদের দেখতে জমা হতে শুরু করেছিলেন। প্রায় ৯০ মিনিট চলে গানের রিহার্সাল। গাঙ্গুলিকে লিখে প্রত্যেকের হাতে একটি করে অনুলিপি তুলে দেওয়া হল। যাঁরা গাইতে না পারবেন, তাঁরা যেন অন্তত সুর মেলাতে পারেন। গলায় একটা স্বেচ্ছাসেবকের মতো একটা করে বিশেষ ব্যাজ ঝুলিয়ে নেওয়া হল। যাতে লেখা হল ‘We are from the city of mother, Kolkata’। তার উপরে লেখা ছিল ’BENGAL’ । খুব সুসজ্জিত ছিল ব্যাজগুলি। প্রস্তুতি সম্পন্ন। চূড়ান্তভাবে যখন রিহার্সাল পর্ব সম্পন্ন হচ্ছে তখন মুখ্যমন্ত্রী সন্তুষ্ট হলেন। নির্দেশ দিলেন, পরের দিন চার তারিখ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে যেন প্রস্তুত হয়ে তাঁর নেতৃত্বে রওনা হই।
৪ তারিখ সকাল। সাড়ে আটটাতেই যাত্রা শুরু হলো মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে। গান করে রোমের শহর ভ্যাটিকানের দিকে আমাদের যাওয়া। ততক্ষনে ভ্যাটিকানে চার্চের সামনে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে গিয়েছে। ততক্ষনে সারা বিশ্ব থেকে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সারা পৃথিবী থেকে ১৮৫ জন বিশপ উপস্থিত। সারা শহরে একটা আলাদা মাধুর্য। আর তার মধ্যে দিয়ে রোমের রাস্তায় নেমেছে এসেছে কলকাতা, নেমেছে এসেছে বাংলা। নেমে এসেছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অত্যন্ত রুচিবান, সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। যাঁরা গান করতে করতে যত এগিয়েছে, রাস্তার দু’পাশের মানুষ অপার বিস্ময়ে লক্ষ করেছে। ‘মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে।..’ গানটি যখন গাওয়া চলছে তখন আমরা ভ্যাটিকান সিটির মুখে পৌঁছে গিয়েছি। কানায় কানায় পরিপূর্ণ পরিবেশ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চার্চের মাথার উপর ঝুলছে মাদার টেরিজার হাতজোড় করা মিষ্টি হাসির নিদারুন সুন্দর প্রতিকৃতি।সুসজ্জিত মঞ্চ।
অতর্কিতে আমরা দেখলাম মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধান, যাঁদের আমন্ত্রণে মুখ্যমন্ত্রীর ভ্যাটিকান সিটিতে যাওয়া। তাঁদের প্রধান সিস্টার প্রেমা অন্তত একশো মিটার মঞ্চ থেকে নিচে নেমে এসে সমস্ত পুলিশ বেষ্টনীকে সরিয়ে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন মূল মঞ্চের দিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনই সিস্টার প্রেমাকে বললেন, পুলিশদের বলে দিন আমার সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলের সকলেই যেন মূল মঞ্চে বসার স্থান পান। আমাদেরও সসম্মানে নিয়ে গিয়ে মূল মঞ্চের পিছনের সারিতে যা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে। আমরা সকলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আসন নিয়ে বসলাম। সকাল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা। দু’ঘন্টার কর্মসূচি ছিল। মাঝখানে একটি অংশে বাংলাতেও প্রার্থনা করা হল। তখন মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে ভারতবর্ষের আর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ যার এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলেন তাঁদের উচ্ছাস চোখে পড়ার মতো ছিল। সমস্ত কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়ার পর মহামান্য পপ-সহ অন্যান্যদের নমস্কার বিনিময় করে মমতা বান্দ্যোপাধ্যায় ফিরে আসেন আমাদের কাছে। প্রখর রৌদ্রতাপ। অভাবনীয় উষ্ণতা। এর মাঝে কিছু বিদেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জনৈক প্রৌঢ়া, তার নাম ছিল ন্যান্সি, একটি হুইল চেয়ার বসিয়ে তাঁর স্বামী তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গলায় কাশি আটকে গিয়ে প্রায় দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসহায় অবস্থায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক স্ত্রীর গলায় হাত দিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ত९ক্ষণা९ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সহযোগিতা করলেন। জলের ছিটে দিলেন মুখে। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকা ওষুধ বের করে তাঁকে খাওয়াতে বললেন এবং তাঁকে অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হাসপাতালের পাঠানোর ব্যবস্থা নিজে দাঁড়িয়ে করলেন। এর মধ্যে মনে হচ্ছিল যে রোম যেন কলকাতা হয়ে গিয়েছে।
সেখান থেকে আমরা ফিরে এলাম। সকলে নিদারুন খুশি। মুখ্যমন্ত্রী এর মধ্যেই কলকাতায় খোঁজ নিলেন মাদার হাউসে। অত্যন্ত সুন্দরভাবে কর্মসূচি পালিত হয়েছে এবং সমাধিক্ষেত্রে ১০৪টি গোলাপ ফুলের পুস্পস্তবক তাঁর তরফ থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোমে বসে থাকলেও বাংলার দিকে তাঁর মন সবসময় পড়ে ছিল। ইতিমধ্যে তিনি একটি ভালো সংবাদ পেয়েছেন। তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস, সর্বভারতীয় ভিত্তিতে সর্বভারতীয় সীকৃতি পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই কথা বলা হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি এই নির্বাচন কমিশনের কাছে কাগজ জমা দিতে গিয়েছিলাম। কতকিছু পদক্ষেপ অতিক্রম করে আজ দল সর্বভারতীয় দলে উন্নীত হয়েছে। টুইট করলেন, উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। চোখের মধ্যে এক নিদারুন তৃপ্তি লক্ষ করলাম। মনে হল এমনভাবে অসম্ভবকে একক শক্তিতে কেউ সম্ভব করতে পারে যা বোধহয় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে স্বপ্নেও ভেবে ওঠা মুশকিল।
পরের দিক সকলেই বায়না ধরলেন, দিদি রোমে শহরটা একবার দেখতে যেতে হবে। দু’ঘন্টার ছোট পরিক্রমা। ইতিহাস বিজড়িত রোমে শহর। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট থেকে শুরু করে যে বাড়ি থেকে মুসোলিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদদের যে স্থান তাঁরা রক্ষা করছেন ‘ওয়াটারহাউস’ নাম দিয়ে। সে সব পরিভ্রমণ করলেন, ঘুরলেন, দেখলেন। খুব পছন্দ হল শহরে কোনও ‘হাইরাইজ’ বিল্ডিং দেখলেন না। তা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে, উচ্চতার মধ্যে। খুব শৃঙ্খলাপরায়ণভাবে শহরের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ। সব দেখে মন্তব্য করলেন, আমাদের দেশেও এমনটা হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের জনসংখ্যা এই পরিবেশ কখনও গড়ে উঠতে দেবে না। একটা পুরো দেশ ইতালিতে যে পরিমান জনসংখ্যা, একটা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা তার থেকে বেশি। ভারতবর্ষের কথা তো বাদই দিলাম। রোমে সফর চার্চের অসাধারণ শিল্পের প্রতিফলন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অতীতের উপস্থিতি এই রোম শহরের সঙ্গে কিভাবে জড়িয়ে রয়েছে তা প্রতি পদে পদে পরখ করে দেখা যায়।
পরের দিন, আমাদের পৌঁছতে হবে জার্মানি। মিউনিখ শহরে। আমাদের রোম থেকে চলে যাওয়া কথা ছিল অন্যত্র। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সেই কর্মসূচি বাতিল করতে হল। সেই সফরসূচিতে জার্মান এয়ারলাইন্সের বিমান লুফতহানসায় করে এসে পৌঁছলাম মিউনিখ। সন্ধ্যাবেলা। সেখানে দেখলাম বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত আছেন অর্থমন্ত্রী ডঃ অমিত মিত্র এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেখান থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন রাত দশটা।
পরের দিন সকাল আটটাতেই অর্থা९ ছ’তারিখ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ডঃ অমিত মিত্রর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত গাড়ির প্রধান কার্যালয় বিএমডব্লিউ-তে। ন’টায় নির্ধারিত একটি বৈঠকের কর্মসূচির খবর পান। সেখানে ডঃ মিত্রের সঙ্গে মুখ্যসচিব, অর্থসচিব, বন্ধন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এবং আমি। আমরা উপস্থিত হলাম। বিএমডব্লিউর সিইও-সহ ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দু’ঘন্টা ব্যাপী বৈঠক। আমি নিজে যেটুকু বুঝলাম যে, বিএমডব্লিউ কর্তৃপক্ষের কাছে এখনও যে ভারতবর্ষের কতগুলি স্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে সেগুলি হচ্ছে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, গুরগাওঁ। কথা প্রসঙ্গে ওঁরা এটা জানালেন যে কলকাতাকে আমরা আমাদের মানচিত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। মানচিত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে সেটা চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী আদালতের যে রায় আমাদের টাটার ন্যানোকে নিয়ে ঘোষিত হয়েছিল সেকথাটিও বিএমডব্লিউ কর্তৃপক্ষকে আমাদের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল। এই ভেবেই জানিয়ে দেওয়া হল, যে তাঁদের মনের মধ্যে যাতে এই ধারণা কখন না হয় সেখানে শিল্পের পরিবেশ আঘাত খেয়েছে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেভাবে শিল্পোদ্যোগীদের নির্দেশ দিয়েছে সেই কোথায় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শুরু থেকে বলে এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে এটা উদ্ধার হল যখন আমরা তাদের বিশাল অট্টালিকার উপর থেকে বিএমডব্লিউর ফ্যাক্টরি দেখছি শুনলে আশ্চর্য হতে হয় তাঁদের ফাক্টরিটি তৈরি ১৫০ একরে। কিন্তু টাটা মোটরস এখানে এক হাজার একর জমি নিয়েছিল। বিরোধী দলে থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ছ’শো একর পর্যন্ত করুন। সেই বিষয়টি তাঁরা অধীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কলকাতা শহরের পার্শবর্তী এলাকার যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান থেকে কলকাতা শহর আসা-যাওয়ার যে ব্যবস্থা, কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন প্রান্তে রাজ্য সরকারের হাতে যে এক লক্ষ দশ হাজার একরেরও বেশি জমির যে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক আছে। যেখান থেকে ইচ্ছা করলেই জমি নিয়ে কাজ করা যায়। সব তাঁরা অধীর আগ্রহে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং অদ্ভুতভাবে আগামী পাঁচ বছর পর দেশের পরিবহন ব্যবস্থা কোন দিকে মোড় নিতে পারে সে সম্পর্কেও তাঁরা তাদের একটি উদাহরণ দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম প্রায় ন্যানোর থেকে একটু ছোট গাড়ি বিএমডব্লিউ বের করেছে। জার্মানির রাস্তায় চলছে। পিছনে দুই, সামনে এক ছোট্ট একটা গাড়ির পিছনের ছাপটা বিএমডব্লিউর। দামটা সতেরো লক্ষ টাকা। কিন্তু মানুষ গাড়িটাকে গ্রহণ করেছে। মোটরবাইক তৈরী করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রোম থেকে জার্মানির উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে আসছিলেন তখন তাঁর সামনে যে ‘পেট্ৰোল’ গাড়ি দেয়া হয়েছিল, তা ছিল দুটি মোটরবাইক। তা ছিল বিএমডব্লিউর। মুগ্ধ বিস্ময়ে মুখ্যমন্ত্রী তখনই বলছিলেন, কলকাতা শহরে ট্রাফিক পেট্রোলে মানে ভিআইপি পেট্রোলের জন্য যে গাড়িগুলি চলাচল করে সেগুলিকে বদলে দেওয়া হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে এবং সেই গাড়ি চালকদের প্রতি অন্যান্য গাড়ি চালকদের যে সম্মান প্রদর্শন, যেভাবে তারা গাড়ি রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, না দেখলে ভাবা যায় না। অন্য গাড়িতে তো চারজন করে বসতে হয়। এতে একজন করে লোক দু’টো করে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই গাড়ি দেখলাম। অমিত মিত্রর সঙ্গে যখন আমরা তাঁদের শোরুম ভিজিট করতে গেলাম অফিসের নিচেই সেই বাইকের উপর তাকে চড়িয়ে বসালাম। একেবারে নতুনভাবে বেরিয়ে এসেছে যে বিএমডব্লিউতে অমিত মিত্র, আমি দুজনে বসলাম। ফটোগ্রাফার ও আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের ছবি তোলার সুযোগ দিতে। সাংবাদিক বন্ধুরা চতুর্দিকে ঘুরেফিরে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখলেন। ফিরে আসলাম এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে। জানতে পারলাম বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ বেঞ্জের মধ্যে সারা বিশ্বজুড়ে এখন প্রচুর প্রতিযোগিতা। কিন্তু অটোমোবাইল শিল্পে জার্মানির অগ্রগতির কথা সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। মুখ্যমন্ত্রীকে এসে জানালাম। হঠা९ করে অধিক উচ্ছাস প্রকাশ করা, কোনও কিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার আগেই প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য দেওয়া এসব থেকে তিনি এখন অনেক দূরে আছেন। আমি এখনও মনে করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিশ্বাসই করছেন যে তিনি চেষ্টা করে যাবেন। তাঁর চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আরও সদর্থক উদ্যোগ, আরও সুচিন্তিত ভাবনার প্রতিফলন এবং বাস্তবের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য সম্ভব এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত মেপে পা ফেলবেন।
ওই দিনে বিকেলে তিনি ভারতবর্ষ থেকে যাওয়া বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। সেখানে মুকেশ আম্বানির প্রতিনিধিও ছিলেন, রতন টাটার প্রতিনিধিও ছিলেন। দেশের আরও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ছিলেন। পরের দিন যে চূড়ান্ত বৈঠক মিউনিখ শহরে হবে সেখানকার বিস্তৃত কর্মসূচি নিয়ে সেখানে আলাপ আলোচনা হল। পরের দিন সেখানে পৌঁছে যাওয়া হল।
সাত তারিখ সকাল। আমাদের সেখানে পৌঁছে জার্মানির ক্যাবিনেট মন্ত্রী বৈঠকে যোগ দিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করলেন। পরবর্তীকালে বৈঠক চলার সময় পাঁচজন জার্মানির কনসার্নের প্রতিনিধি, পাঁচজন বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগী ও আমাদের ভারতীয়দের পক্ষে পাঁচজন। মোট দশজন সেখানে বক্তব্য রাখলেন। মুখ্যমন্ত্রী পরবর্তীকালে তাঁর সাবলীল ভঙ্গিতে যে বক্তব্য রাখলেন তা এক কথায় অত্যন্ত প্রাণস্পর্শী। টাটার প্রতিনিধি যখন এসে বললেন সরকারের কাছ থেকে টাটা স্টিল প্রচুররকম সহযোগিতা পেয়ে থাকে। মুকেশ আম্বানির প্রতিনিধি যখন বললেন আগামী দিন পশ্চিবমবাংলাই হচ্ছে মূল লক্ষ পথ। এটাই আমাদের চেয়ারম্যান বিশ্বাস করেন। তখন আমরা গর্ব অনুভব করছি।এবং জার্মানিতেও বহু সংখ্যায় ভারতীয় কীভাবে শিল্পের সঙ্গে, কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন তা সেখানে গিয়ে একবার নজর কাড়ল। আমার মনে হয় বাংলা থেকে যে বক্তারা সেখানে বক্তব্য রাখলেন যে উত্সাহ, যে উদ্যোগ নিয়ে তাঁরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিলেন তাতে দেশ স্বাধীনতার পর নিজের রাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এমনভাবে বাংলাকে তুলে ধরতে কখনও দেখা যায়নি। একসুরে, একটাই কথা, ‘বাংলায় বিনিয়োগ করুন, বাংলায় আসুন’। সকলের একটি নিদারুণ সহযোগিতায় একটি সফল সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, যে বাংলা আগামী দিনের সদর্থক পদক্ষেপে শিল্পায়নের দিকে এগোবে এবং ছোট মাঝারি শিল্পের সঙ্গে বড় শিল্পের স্থাপনের দিকেও তাদের নজর থাকবে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না এবং জার্মানিকে তাদের মন্ত্রীর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন যে জানুয়ারি মাসে যে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন আবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে তাতে যেন জার্মানির ভালো সংখ্যায় প্রতিনিধিরা যেন উপস্থিত থাকেন। বিএমডাব্লিউয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওই সম্মেলন সম্পন্ন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করলেন। আমার যা মনে হয়েছে যতটুকু ঘটছে তাতে আপাতত সেটুকুর মধ্যে গোটা বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্চনীয়। অতিরিক্ত আশার ফুলঝুরি দেখিয়ে পরবর্তীকালে কোনও পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হল না সেই পদ্ধতিতে যাওয়া কখনওই ঠিক নয়। অতিরিক্ত উচ্ছাস প্রদর্শন করে বাস্তবের সঙ্গে তার সাযুজ্য বা মিল রইল না এমন রাস্তাতেও হাঁটা ঠিক নয়। আর সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী কোন ঘটনাকে একটা অতিরিক্ত উচ্চতায় তুলতে চাইলেন না বলে তিনি একটা অসাধারণ মনোভাব নিলেন। যাতে প্রমাণিত হল তিনি তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাংলার শিল্পায়ন চান। কিন্তু তার জন্য কোনও এমন উচ্চতায় বিনা কারণে তুলতে চান না যা পরবর্তী কালে সমালোচকদের মুখ খুলতে সহায়তা করে।
ফিরে আসার পালা। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী সর্বোচ্চ পদযাত্রা একদিকে ১৬ কিলোমিটার। আসার আগের দিন আট তারিখ। এই একটি বিষয়ে তাঁর এক সহযোগীকে রোজ দেখতে পাওয়া যেত না। পালা পরিবর্তন করে হাঁটতে হত। কিন্তু তিনি থাকেন প্রতিদিনই একই রকম। তিনি চলেন, বিভিন্নভাবে মানুষ তাঁর পাশে আসেন। হাঁটতেই থাকেন। তিনি চলতেই থাকেন। জীবনের আরও একটি নাম তো চলা। আর সেই সেই চলার পথে তিনি কখনও খামতি দিতে চান না। এই কয়েকদিনের সফরে থেকে দেখলাম তাঁর মানবিকতার দিক। সকলকে নিয়ে একটি পরিবারের মতো থাকার দিক। বিশ্ব বাংলা যে একটা শুধু স্লোগান নয়, বিশ্ব বাংলা যে একটা উপলব্ধি, বোধ। বিশ্ব বাংলা রোম এবং জার্মানির মতো দু’টি স্থানে তার উপস্থিতি প্রমাণ করে সার্থকভাবে ফিরে এল এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আরও ব্যাপকভাবে চালু থাকবে। আর সে কারণেই আগামী নভেম্বরে আবার ভারত-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর সকলে মিলে আরও বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে বাংলার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্ব দেবেন। যা সম্পন্ন হতে চলেছে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। বিমানে ফেরা। মিউনিখ-দুবাই-কলকাতা। সেখানেও পায়ে হাঁটা। সকলকে তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে দেওয়া। ফেরার সময় এমিরেটস বিমান কর্তৃপক্ষের অন্যতম কর্ণধার স্বয়ং এসে মুখ্যমন্ত্রীকে এবং সদলবলে তাঁর সমস্ত টিমের সহযাত্রীদের একসঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। বিমানবন্দরে দুবাইয়ের মতো অনেক কড়াকড়ির ব্যবস্থা। যেখানে এই সম্মান তাঁরা সুষমা স্বরাজকেও দেননি বলে আমরা জানলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তা দিলেন। বিমানের মধ্যে বিমান সেবিকাদের ছবি তোলার নিদারুণ আগ্রহ। মিউনিখ বিমানবন্দরেও ভারতীয়দের মধ্যে এমন এক প্রচলিত মুখ যা সত্যিই আমাদের গর্বের এবং অহংকারের।