October 8, 2016
সংগ্রামই জীবন: অভিষেক বন্ধোপাধ্যায়

যত মত তত পথ, যত্র জীব তত্র শিব, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, উক্তিগুলি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের। সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান মানবজীবন এবং তাঁর বাণী। প্রাচীন সভ্যতার তীর্থ ভারতে দূর অতীতের শ্রীমদভাগবতগীতাতে আছে ভগবান যুগে যুগে ধর্মের গ্লানি বিমোচন, দুর্বৃত্তের বিনাশ ও সত্য ধর্মকে প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষার জন্য আবির্ভূত হন অবতার হয়ে।
আধুনিক বিশ্ব পরিস্থিতি ও ভারতীয় সভ্যতার মহিমাময় আদর্শের অবক্ষয় ও অপমৃত্যুর সংকট মুহূর্তে পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণের আবির্ভাব এমন একটি বাস্তৱ ঘটনা।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যৌবন। যৌবন জীবনের একটি সন্ধিক্ষণ, বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের সময় এটা। যুবকরা শুধু সমাজের নয়, সমগ্র জাতির বলিষ্ঠতম অংশ বিশেষ।তাই যুবকদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয় যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে। আমাদের সমাজ সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী।তবু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর চতুর্দিকে কুসংস্কার, জাতিভেদ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দারিদ্র ও নিপীড়ন। এসবের মধ্যেই মাঝে মাঝে নেমে আসে প্রকৃতির অভিশাপ ক্ষরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি। ফলস্বরূপ দেখা যায় কত মানুষের গৃহহীন দুরবস্থার চিত্র। এই অবস্থায় সেবাদর্শের অনুভব নিয়ে জাতির বলিষ্ঠতম অংশ অর্থাৎ যুব সমাজ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে আর কে আসবে।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ত্যাগ বৈরাগ্যই ভারতের সনাতন আদর্শ। সাহস, আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজসেবাই মুক্তির পথ। স্বামীজীর উদাত্ত ঘোষণা “মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করার জন্য, তাকে অনুসরণ করার জন্য নয়। শিবজ্ঞানে জীব সেবা।” আমরা যুবকরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানব জীবন ফুলের পাপড়ি বিছানো পথে চলে না, সংগ্রামই জীবন। বর্তমানে জীবন দারুন প্রতিযোগিতাপূর্ণ।
বর্তমানে নিজের ঘর নিজেকেই বাঁধতে হয় তাই পৌরুষই যুবকের শ্রেষ্ঠ মূলধন। পৌরুষ অর্জিত হয় গভীর মনোযোগে, নিরন্তন অভ্যাসে, নিরলস কর্মে, সময়নিষ্ঠায়, এবং বিনম্র আনুগত্যে।বলা বাহুল্য এগুলোই শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতারই স্বর্ণ ফসল। পৌরুষ অর্থে বীর সংকল্প, সুক্ষ বিচার বুদ্ধি, অনুশীলন ও সৃজন শক্তি, কর্মনিষ্ঠা, চিত্তের সুকুমার বৃত্তিগুলির পরিচর্যা ও পরিস্ফুটন, লোক ব্যবহারে সৌজন্য, শিষ্টতা ও সামাজিক বোধ, এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে সচেতনতা প্রভৃতির সম্মিলিত রূপটি পৌরুষ বা পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব। যৌবনেই এগুলো আয়ত্তের প্রকৃষ্ট সময়। আর তা শৃঙ্খলাবোধ বা নিয়মানুবর্তীতারই আশীর্বাদ। দায়িত্বচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ যুবক দেশ ও জাতির গৌরব। যৌবন তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে ভরপুর। শক্তি ও উদ্দীপনার মিলিত প্রয়াসে যুবকদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে দেশ ও সমাজের কল্যানে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা যুবকরাই ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের স্রষ্টা। বর্তমানে দেশের নাগরিক। আমাদেরই সমৃদ্ধ ভারত গঠন করতে হবে।
আমাদের যুবকদের বুঝতে হবে রাজনীতিতে কি? জীবনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জনে আর দশটা বৃত্তির মতো রাজনীতিও যেন একটা পেশা মাত্র, এ পেশায় আদর্শ ও অনুভূতির চেয়ে কূটনৈতিক পারদর্শিতায় বেশি প্রয়োজন, সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতি ক্রমশ এই তাৎপর্যই লাভ করতে শুরু করেছে। আজ তাই রাজনীতি বা রাজনীতিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অর্থাৎ জনসাধারণের তেমন শ্রদ্ধার ভাব নেই। যুবকদের এটাও বুঝতে হবে রাজনীতি কোনো পেশা নয়। স্বদেশসেবার পরম আদর্শ রাজনীতি সম্মান দেবে, সমাজে বিত্ত ও প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করবে, এই পেশাদারি মোহ থাকলে চলবে না।
মহাত্মা গান্ধী যেমন রাজনীতিকে বলেছেন, ‘ধর্ম’, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও তেমনই রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘সম্মিলিত সাধনা’ তথা ‘Collective Sadhana’ নামে। ধর্ম বা সাধনার আবেদন পেশাদারিতে নয়-আদর্শানুরাগের নিষ্ঠা ও হৃদয়ের অনুভূতিতে। যুবকদের মনে রাখতে হবে রাজনীতি পেশা নয়-আদর্শ ব্রত। মানুষের উপকারে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। রাজনীতিকদের মন যখন আদর্শানুরাগের অনুভূমিততে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন মান যশ প্রতিস্ঠার কোনোও আকাঙ্খা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না। আদর্শানুরাগ, জানসেবাব্রতীর জীবনকে যখন সুরভিত করে তোলে তার জীবন তখন দুর্জয় প্রচেষ্টায় দুঃসাহসিক অভিযান হয়ে ওঠে নিঃশঙ্ক ও নির্ভীক। জেনে রাখবে আদর্শের মৃত্যু নেই, আদর্শ-মৃত্যুঞ্জয়ী।
আমাদের দেশে শত শত মহাপুরুষ জন্মেছেন অথচ তাঁদের আবির্ভাব সত্ত্বেও আজ দেশ কি শোচনীয় অবস্থায় পরে আছে। জাতিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিদের কোনো স্বার্থকতা নেই-একথা আজ আমাদের সকলকে বুঝতে হবে আর এজন্যই আজ চাই ‘সম্মিলিত সাধনা-Collective Sadhana’।
আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব বিভিন্ন দেশে ও কালে কালে বহু উন্নত জাতি ও সভ্ভতার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আজ সেসব দেশের ভূগোল বেঁচে আছে বটে, কিন্তু ইতিহাস স্থানলাভ করেছে প্রত্নতত্ত্বের জীর্ণ পাতায়। যেমন মিশর দেশটি আছে, পিরামিডও আছে কিন্তু অতীতের মিশরের প্রানধারা বেঁচে নেই ; ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান আছে কিন্তু ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নেই ; তেমনি গ্রিস আছে গ্রিসের স্থাপত্য আছে কিন্তু গ্রিক সভ্যতার আত্মা আজ বেঁচে নেই। কিন্তু শত বিপর্যয়ের মধ্যেও ভারতবর্ষের জীবনস্রোত অবিচ্ছিন্ন রয়েছে। হাজার হাজার বছর আগেকার অর্থাৎ অতীতকাল থেকে আজকের দিনেও ভারতবাসীর জীবনে ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারা অবিচ্ছিন্ন রয়েছে।
যৌবন শক্তি চির অশান্ত, চির অবুঝ। অকারণে ঔদ্ধত্য, অপ্রয়োজনে দুর্বার বিদ্রোহ, চির-চাঞ্চল্যের উদ্দাম প্রানধারার ঊর্মিমুখর অপরিমিত উচ্ছাস-ইটা যৌবনের ধর্ম। যৌবন ভাঙতে পারে আবার গড়তেও পারে, আত্মবিলোপ করতে পারে, আবার আত্মবিকাশও করতে পারে। যৌবনের এই ধর্মকে স্মরণ রেখেই যুব আন্দোলনের মূল আহ্বান হওয়া উচিত বন্ধন থেকে মুক্তি, সংস্কার ও চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মানবতা বিরোধী স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান।
স্বামীজীর ভাবাদর্শে একাগ্র চিত্রে স্মরণ মনন করে আজ বাংলা তথা ভারতবর্ষের একমাত্র অবিসংবাদী নেত্রী মমতা বন্ধোপাধ্যায়। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আদর্শ ও অনুপ্রেরণা সর্বোপরি মানবসেবায় দিদির পথই আমার পথ।