Latest News

October 3, 2014

মমতার সংগ্রাম, শাণিত চেতনা – সুব্রত বক্সী

মমতার সংগ্রাম, শাণিত চেতনা – সুব্রত বক্সী

শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেদিনের আন্দোলনে স্বীকৃতি পেয়েছে মানুষের সচিত্র পরিচয় পত্রের দাবি। সারা জীবনের জন্য `একুশে জুলাই` সংগ্রামী মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক…

এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আজ বাংলার রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। জীবনের চলার পথে শঙ্কটের এই মুহূর্তে অতীতের অভিজ্ঞতাই হাতিয়ার। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চোখ রেখে চেতনায় শান দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতিটা পদক্ষেপ আরও একবার ফিরে দেখা প্রয়োজন।

কংগ্রেসের পতাকাতলে শুরু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের  নেতৃত্বে আট-নয়ের দশক উত্তাল করে একের পর এক আন্দোলন হয়েছে। মানুষের দাবি নিয়ে বারবার আঘাত হানা হয়েছে। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সারকারের অপশাসনের মুলে। সেদিন অবিভক্ত কংগ্রেসের যুবনেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপলব্ধি করেছিলেন, ভোটের বাক্সে মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মৌলিক মর্যাদাটুকুও দিতে চায়ে না কমিউনিস্ট  পার্টি মার্কসবাদীর শাসকরা। তাই ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে ঐতিহাসিক মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন কাকদ্বিপ থেকে কোচবিহার উদ্বেল করে হাজার হাজার ছাত্র-যুব, জনতার মিছিল আছড়ে পড়েছিল কলকাতার রাজপথে। সেদিনের আন্দোলন বামফ্রন্ট সরকারের ভিত কতটা নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল তা জানা নেই, কিন্তু অধিকারের দাবিতে জাতীয়তাবাদী যুবকদের মিছিল নিঃসন্দেহেই বুক কাঁপিয়ে দিইয়েছিল মহাকরণের তৎকালীন শাকদের। সে কারণেই বিনা প্ররচনায়ে পুলিশের গুলিতে কলকাতার রাজপথে ১৩জন সহযোগীকে হারাতে হয়েছিল আমাদের।

শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়েনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেদিনের আন্দোলনে স্বীকৃতি পেয়েছে মানুষের সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবি। সারা জীবনের জন্য `একুশে জুলাই` সংগ্রামী মানুষের কাছে লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে গিয়েছে।

এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষকে একত্রিত করার জন্য মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে ১২ জানুয়ারি, স্বামী বিবেকানন্দর জন্মদিনে কংগ্রেসের পতাকা কাঁধে নিয়ে শুরু করেছিলেন জনসংযোগ জাত্রা। অবিভক্ত মেদিনীপুর থেকে সেই যাত্রা সারা বাংলার যজুবসমাজকে উত্তাল করে তলে। টানা সাতমাস রাস্তায়ে রাস্তায়ে ঘুরে ১৮৭টি বিধানসভা অতিক্রম করেছিলেন। বাংলার মানুষকে সঙঘবদ্ধ করে নিরবচনে অংশ নেয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠনের দায়িত্বে থাকার সুবাদে সারা রাজ্য ঘুরে উপলদ্ধি করেছিলেন বিভিন্ন লকআপে ১৭৮জন বন্দিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সারকারের পুলিশ। সেই ১৭৮টি পরিবারকে চাকরি ও আর্থিক সাহায্যের দাবিতে কলকাতার রাজপথে ১৯৯৫ সালে ৬ অক্টোবর ধরনা অভিযান করেছিলেন। ২৩ দিনের মাথায়ে মমতার সেই আন্দোলন বাংলা ছেড়ে দিল্লি মসনদে আছড়ে পরেছিল।

তদানীন্তন দিল্লি কংরেসের সহায়তায় বাংলার চালু হয়েছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তাই আজও বাংলার মানুষ প্রশাসনের কাছে বিচার না পেলে ছুটে যায়ে মানবাধিকার কমিশনের কাছে।

এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের  বহু আন্দলনের মধ্য দিয়ে মানুষ সঙঘগবদ্ধ হলেও কোনও এক অজানা কারণে নির্বাচনে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সন্ধিক্ষ্ণণে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, `বাংলার মাটিতে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে কংরগ্রেসর পতাকা হাতে করে করা যাবে না।` তাই ১৯৯৮ সালে পয়লা জানুয়ারি বাংলার মাটিতে জান্ম দিয়েছিলেন নতুন রাজনৈতিক দল পাশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস।

কংগ্রেসের পতাকা, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক – সামনে মমতা। শুরু হয়েছিল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

আজ আমরা ১৭ বছর অতিক্রম করেছি। বাংলার মাটিতে কোলের শিশুর মতো একটা রাজনৈতিক দলকে শৈশব থেকে কইশর, কৈশোর থেকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ১৭ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের  রাজনৈতিক ইতিহাস বাংলার মানুষকে নতুন করে বলার অবকাশ নেই। নিরলস ভঙ্গিতে তিনি চলেছেন বাংলার অত্যাচারিত মানুষের স্বার্থে একটার পর একটা আন্দোলন – সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কখনও তাঁর সভায় লাখো মানুষের সমাবেস, কখনও কিছুটা শ্লথ। কখনও দুটো আসন বেশি, কখনও দুটো আসন কম।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের জন্য চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলেছেন। মানুষের দৈ্নন্দিন জীবনের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন `মমতা`।
চলতে চলতে আমরা এলাম ২০০৬-এ। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না এই দাবি নিয়ে সিঙ্গুর ব্লকে শুরু হল আন্দলন। এই আন্দলনের পাশে দাড়িয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন তা আজও নাজিরবিহীন। কারণ, স্বাধীনতার ৬৮ বছর পরে দেশের সর্ববৃহৎ অহিংস গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংঠিত করেছিলেন তাঁর ২৬ দিন অনশনের মধ্যে দিয়ে। সেই আন্দোলন শুধু বাংলার আলড়িত করেনি, আঁচড়ে পরেছিল দিল্লির দোরগোড়ায়। এই আন্দোলনের ভিতের উপর নির্ভর করেই ভারতের মাটিতে সুপ্রাচীন ১৮৯৪ সালে জমি অধিগ্রহণের আইন বদলে নতুন আইন প্রণয়ন হয়েছে। যদিও নীতিগতভাবে আমরা সেই আইনের সমর্থক নই।

পরবর্তী পর্যায়ে ২০০৭। নান্দিগ্রামের আন্দলনের পাশে থেকে মানুষের লড়াইয়ের রসদ জুগিয়েছেন। আমরা দেখেছি রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনা। ধাপে ধাপে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে আরও সাংগঠিত হয়েছেন। বাংলার মানুষের মধ্যে আশা জেগেছে যে সংসদীয় গনতান্ত্রের রীতিনিতির মধ্য দিয়েই এ রাজ্যে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অপশাসনের অবসান সম্ভব। তার প্রামাণ আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ২০০৯ সালের লকসভা নির্বাচন ও ২০১০ সালে রাজ্যজুরে পুর নির্বাচনে।

পরবর্তী সময় আমরা দেখেছি সেই ঐতিহাসিক বিধানসভা নির্বাচন। তখন ইতিমধ্যেই বাংলার মাটিতে একটি পরিবর্তনের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের কাছে আবেদন করেছিলেন, `পরিবর্তনের বাতাবরণকে যদি মানুষ সমর্থন করেন, তবে একটা সন্ত্রাসমুক্ত, উন্নয়ন্মুখী, যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থানমুখী বাংলা গড়ে তুলতে পারি`। বাংলার সর্বধর্মের মানুষ,  সর্বজাতির মানুষ, সব পেশার মানুষ এক হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন সরকার গঠন করলেন ২০১১ সালে ২০ মে।

অনেক অভিঞ্জতার বাঁক পেরিয়ে সরকারের বয়েস এখন প্রায়ে ৩৯ মাস। ইতিমধ্যেই এই সারকার মানুষের কাছে মা-মাটি-মানুষের সরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  বাংলার মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সান্ত্রাসমুক্ত বাংলা, উন্নয়ন্মুখী বাংলা এবং যুবক যুবতীর কর্মসংস্থানমুখী বাংলা গড়তে। সন্ত্রাসমুক্ত বাংলা গড়তে। সন্ত্রাসমুক্ত বাংলা বলতে নতুন করে আর বলার অবকাশ নেই। সুদুর দার্জিলিং থেকে জঙ্গলমহলের মানুষ আজ পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছেন।

সর্বত্রই আজ শান্তির বাতাবরণ। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ নিয়ে এখন জেলায় জেলায় পৌঁছে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মানুষের পওনাকে মানুষের অধিকারে পরিণত করছেন। উন্নয়নের সুফল পাচ্ছেন মানুষ। তাই ছোট বড় সব নির্বাচনেই দুই হাথ ভরে আশীর্বাদ নিয়ে মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে। বহু সরকারি প্রকল্পে মধ্য দিয়ে দৈনদ্নিন জীবনের সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখছে মানুষ।

সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্বিক কর্মযজ্ঞ, মানুষের সম্মানজনক   ভাবে বেঁচে থাকার সার্বিক প্রতিক্রিয়াটাকে একদল বিরোধী রাজনইতিক দল ও সংবাদমাধ্যমের একাংশ ধ্বংস করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  তাঁর ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে মোকাবিলা করতে করতে বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে আপনারদের আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে এসেছেন। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জীবনকে শেষ করে দিয়ে না খেতে পাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনশন করেছেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচার চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যাক্তিগতভাবে কালিমালিপ্ত করে রাজনৈতিক ময়দান থেকে দূরে রাখার যে প্রচেষ্টা চলছে তা এক ভয়েঙ্কর পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক মোকাবিলা করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে ধ্বংস করার যে প্রতিক্রিয়া চলছে তা প্রতিরোধ করেতে হবে। কারণ, তৃণমূল কংগ্রেস শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়ে, তৃণমূল কংগ্রেস বাংলার কোটি কোটি মানুষের আস্থা ও ভরসার শক্ত জমি ।

আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত নই। আমরা সিপিএমের সমস্ত রকম আক্রমণ দেখেছি। মোকাবিলা করেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে। বাংলার ঘরে ঘরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছেছেন । এখনকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মতো ধোপদুরস্ত হয়ে টিভি চ্যানেল কিংবা খবরের কাগজ ছবি ছাপিয়ে রাজনৈতিক জীবন তৈরি করেননি। এঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের জীবন উপলদ্ধি করতে পারেননি । এঁদের বলব এই ভয়ঙ্কর খেলায় মাতবেন না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ক্ষমা করবেন না।