Latest News

October 7, 2016

নির্বাচন ২০১৬: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

নির্বাচন ২০১৬: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কু९সার ঝড় পেরিয়ে একটা বড় রাজনৈতিক সুনামি সামলে এলাম আমাদের জাতীয় উ९সব বাংলার দুর্গাপুজোর তিন মাস আগে। পুজো এসে গেলেই ‘জাগো বাংলা’র পুজো সংখ্যার জন্য একটা লেখার অনুরোধ আসে। সময়ের অভাবে যখনই কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে যাই অখন ওই ৪০/৪৫ মিনিট সময় যাতায়াতের রাস্তায় হাতে থাকে। আর যা থাকে, লেখার কাজ, তখন মেঘ-রৌদ্রে সেরে নিই আর কী!

এবারেও তার ব্যতিক্রম কোথায়? ২০১১ সালের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর বেসামাল আর্থিক ধস সামলেও পাঁচ বছর যে কাজ আমাদের সরকার মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদে করেছে তা এককথায় সাধ্যমতো চেষ্টায় অনবদ্য। যার ফলশ্রুতি ও বিশ্বাসে সাধারণ মানুষ তৈরি ছিলেন মনে মনে আশীর্বাদে ভালোবাসায় ও দোয়ায় আমাদের সমর্থন করতে।

কিন্তু হঠা९ করে নয়। বেশ পরিকল্পনা করে একেবারে দিল্লি থেকে কলকাতা! কিন্তু এবারের ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল প্রতিদিন, তা সত্যি সত্যিই চাক্ষুষ করলেন সাধারন মানুষ।

উপলব্ধির গভীরে চক্রান্তর শিকড় এতটাই নিমজ্জিত ছিল যে কখনও কখনও কু९সা কথার জ্বালায় প্রখর দেবতাও প্রায় দগ্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। আর আমার কান সবতা এলেও আমার knowledge  -এ সবটা থাকলেও, আমি আমার মতো  মার্চ-এপ্রিল মাস, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রখর রৌদ্র দহনের দারুন অগ্নিবাণে আর শুষ্ক ধুলোর, গ্রীষ্ম ধুলায় কিঞ্চি९ জ্বলনে, দহনে দগ্ধ হচ্ছিলাম। তাই সব কিছু দেখেও মানুষের প্রতি বিশ্বাসের জোরে মানব বৃক্ষের ছাতার তলে আশ্রয় নেওয়ার ফলে মনের বিশ্বাস-এর রাস্তাটা আমার কাছে এতটাই অক্ষত ছিল যে আমি আমি নিজেকে কখনওই দুর্বল মনে করিনি। শুধু ভাবতাম এত গরমের দিনে টানা আড়াই-তিন মাস প্রতিদিন প্রচার চালিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রচারটা শেষ করতে পারব তো? এক জেলা থেকে আর এক জেলা কখনও বা দিনে দুটো তিনটে জেলা কভার করতে হত।

আর তার মধ্যেই আসত নানারকম চক্রান্ত ও অভিসন্ধিমূলক খবরের খবর। দিল্লি থেকে কলকাতা যেভাবে আমাদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নির্বাচনের সময়েও সমস্ত নীতি বিসর্জন করে এক রাজনৈতিক অভীলিপ্সা যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে লাঞ্ছনা করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। আমাদে দলের কর্মীরা বহু কঠিন পরিস্থিতি ও আন্দোলন থেকে উঠে আসা বলেই এত বড় একটা অসম লড়াই করেও মানুষের আশীর্বাদে ও শুভেচ্ছায় জিতে এসেছে।

আমরা জিতিনি, জিতেছে মানুষ। এ লড়াই থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে।

Big Money power কীভাবে রাতারাতি জোট সরকার তৈরি করে ফেলেছিল, জোট সরকারের হোতাবাবুরা – কীভাবে সংবাদমাধ্যমের এক বড় অংশ, দিল্লির প্রভাবশালী চক্রব্যূহ সব একসঙ্গে একজোট হয়ে অনৈতিক নির্বাচনের সুযোগে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আমাদের, যা সব সীমাকে ছাড়িয়ে এক সীমাহীন সন্ত্রাসের সন্ত্রাসী বিস্ফোরণ।

এমন কোন জায়গা ছিল না বাকি এমনকি প্রশাসনকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি, সর্বত্রই খবরদারি করার, সর্বোচ্চ পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিকল্পিত হয়েছিল। এমনকি সব সৌজন্যকে বিসর্জন দিয়ে, আমি যেখানে থাকি, সেখানে আমাকেও হারানোর জন্য ভোটের আগের দিন আমাদের পাড়ার প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোতেও বিরোধী দলগুলোর মাতব্বরদের কথায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আগে শুধু ভোটকেন্দ্রের সামনে ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হত, আর এবার একেবারে এক অঘোষিত কারফিউ জারি করে সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের উ९সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সবরকম চক্রান্ত করা হয়েছিল। একসঙ্গে চার-পাঁচ জনকে এমনকি ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের ভোট পুলিশ। এলাকায় এলাকায় নির্বাচন কমিশনের পদ্ধতি মেনে অনুমতি নিয়েও বুথ ক্যাম্প করতে দেওয়া হয়নি।

অনেক কাছ থেকে অনেক ঘটনা জেনেছি নির্বাচনের দিনগুলোকে কেন্দ্র করে। আমাদের দীর্ঘদিনের সাথী শোভনদা, মানে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জিনি সারা জীবন রাজনৈতিক শ্রমিক আন্দোলন অথবা বিভিন্ন খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত, আমাকে বললেন, “জানিস তো মমতা, আমি রাসবিহারীর প্রার্থী হিসেবে যোধপুর পার্কের একটা ভোট কেন্দ্রে আইন অনুযায়ী ভোট কেমন চলছে দেখতে গেছি, আমাকে কয়েক জন ভোট পুলিশ (CRPF) ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আমি বললাম, ভাই আমি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী। আমার অনুমতি আছে ভিতরে যাওয়ার। ওই ভোট পুলিশগুলো বলল, “আপ তৃণমূল কংগ্রেস কা হ্যায়। আপলোগ কি খিলাপমে action করনা হামারা দিল্লিকা instruction হ্যায়। বলে ধাক্কা দিয়ে আমাকে বের করে দিল”। শোভনদা বলেছিলেন, “জানিস তো লজ্জায় আর অপমানে আমার মাথায় আগুন চেপে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের যাতে ভোটে কোনও অসুবিধা না হয় তাই সব সহ্য করেছি। এই ঔদ্ধত্য? বহিরাগতদের! যা চিরকাল মনে থাকবে।

শোভনদা আমাকে আরও জানান, “জানিস তো তোর সুপ্রিয়া বৌদি (মানে শোভনদার স্ত্রী) দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে শয্যাশায়ী। থাকেন ভবানীপুরে”। তাঁকে immediate  হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। Ambulance কে ফোন করলাম, জানতে পারলাম ভোট পুলিশরা Ambulance যেখানে থাকে সেখানে তালা দিয়ে চলে গিয়েছে”।

মেডিসিনের দোকান থেকে খাবারের দোকান সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নকুরের মিষ্টির দোকানে, তাদের মারধর করা হয়েছিল। এ-ঘটনাটা তো সবার জানা।

আমার পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমাকে জানালেন, “ম্যাডাম আমি ভোট দিতে যাচ্ছিলাম, কয়েকজন ভোট পুলিশ ভোটকেন্দ্রের বাইরে আমাকে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করছিল। যাতে আমি ভোট দিতে না যাই। এবার আমি আমার পরিচয় দিলাম, তখন বলছে, ‘সব গন্ধা হ্যায়”। অর্থা९ এইভাবে, যেভাবে বিশেষ নির্দেশনায় এবার নির্বাচন করা হয়েছে, তা যেকোনও জরুরি অবস্থার থেকে ভয়াবহ বলা যেতে পারে।

প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ জনের মতো ভালো ভালো অফিসারকে সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের কথায় যেভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর তাদের পছন্দমত লোকজনদের দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছিল তাও ভবিষ্য९ ইতিহাসের অনৈতিক অনেক সাক্ষী হয়ে থাকবে।

ভোটের দুদিন আগে থেকে এলাকায় এলাকায় গিয়ে আমাদের নেতৃবৃন্দ ও সংগঠকদের উপরে যেভাবে সন্ত্রাস করা হয়েছে তা গণতান্ত্রিক ইতিহাসে চিরদিনের চিরলজ্জা হিসাবে থাকবে।

এছাড়াও নানারকম অভিযোগ, মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে অনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অনেক তৃণমূল কংগ্রেসির বিরুদ্ধে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ বারবার করা হয়েছে তার কোনও একটারও বিচার হয়নি।

অভিযোগ দেখা যার দায়িত্বে ছিল, তিনি নাকি সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপিরটা দেখলেই তাঁর জিভ দিয়ে জল পড়ত। আর তৃণমূল কংগ্রেসের পত্র দেখলেই তাঁকে সরিয়ে রাখতেন। এই তো ২০১৬-র নির্বাচনী বৃত্তান্ত। জোটের কর্ণধাররা যারা অর্থ, দিল্লি সহ ভোট পুলিশ প্রশাসনের এক বড় আমলা, দিল্লির সবরকম মদত ও ইশারায় বাংলা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একতরফা চক্রান্ত করেছিলেন তাদের সব চক্রান্ত থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা ও দোয়ায় এ নির্বাচনী ফলাফল সত্যিই ভাবা যায় না। এ দান যে কত বড় দান সে তো চক্রান্তের নারদমুনিদের দেখলেই বোঝা যায়।

তা সত্ত্বেও শেষ হাসি মানুষের। সত্যের জয় মানুষের। বিশ্বাস ও আস্থার জয়- গণতন্ত্রের। অনেক শিক্ষা, অনেক অভিজ্ঞতা ও অনেক চক্রান্ত ও কু९সার ঝড় পেরিয়ে ২০১৬-র নির্বাচন গণতন্ত্রকে নতুন করে সমৃদ্ধ করল। যার থেকে বড় শিক্ষা। ‘মানুষের থেকে বড় কেউ নয়’।

গণতন্ত্রের প্রধান ভরসা মানুষ। চক্রান্তের ব্লুপ্রিন্ট নয়।

মা-মাটি-মানুষকে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই। ‘পুজো’ সকলের খুব ভালো কাটুক। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবার জন্য রইল প্রিয় দুর্গাপুজোর ‘শিউলি উ९সবে’ আমাদের প্রাণভরা শুভেচ্ছা। বড়দের প্রণাম-সালাম। ছোটদের নবীন প্রজন্মকে অনেক অভিনন্দন ও ভালবাসা।

শুভ পুজোর বাজনা বাজুক সবার ঘরে ঘরে।