কৃষি থেকে শিল্প – বাংলাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কাজ শুরু জননেত্রীর: সুব্রত বক্সী

গণতন্ত্র রক্ষা ও তাকে মর্যাদা দেওয়ার একমাত্র শর্ত নিয়ে ১৯৯৮ সালে তৈরী হল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই থেকে লড়াই শুরু। বাংলার বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরি, ভোটাধিকার-সহ মানুষের গণতান্ত্রিক ন্যূনতম অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু করলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। আর যেহেতু গণতন্ত্রের জন্য লড়াই, সেজন্যই তা সবচেয়ে কঠিন।

একদিকে বামফ্রন্ট, আর অন্যদিকে কংগ্রেস তখন বাংলার মা-মাটি-মানুষের স্বার্থ পদদলিত করছে। লড়াই-আত্মত্যাগের বিনিময়ে মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে লড়াই শুরু করলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। অন্যদিকে, ঘটে চলেছে রাজনৈতিক খুন। রাজনীতির নামে খুন হচ্ছে সাধারণ মানুষ।পাহাড় জ্বলছে।অশান্ত জঙ্গলমহল।দরিদ্র মানুষের মুখে সামান্য অন্ন তুলে দেওয়ার নামে চলছে নোংরা রাজনীতি। লড়াই আরও কঠিন হল। দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিলেন জননেত্রী। চলতে থাকলো সংগ্রাম।

এই অবস্থা থেকে এল ২০০৬ সাল। বাংলায় সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের স্বার্থ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেল। রক্তাক্ত হলো সিঙ্গুরের মাটি। নিজের জীবন বাজি রেখে কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনশনে বসলেন জননেত্রী। তার পর ২০০৭-এ নন্দীগ্রাম। মমতার লড়াইকে সামনে রেখে রুখে দাঁড়াল নন্দীগ্রামের মানুষ। পরের বছর ২০০৮-এ ঘটে গেলো রিজওয়ানুর রহমান খুনের মতো ঘটনা। একটি সম্পর্ককে স্রেফ শ্রেনির বিচারে মর্যাদা না দিতে চেয়ে বাম-ঘনিষ্ট শক্তি খুন করল এক তরতাজা প্রতিভাবান মুসলিম যুবককে। দক্ষিন কলকাতা লাগোয়া তপসিয়ার ঘুপচি গলিতে তাঁর পরিবারের পাশে, তাঁর মায়ের পাশে ছুটে গেলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলায় পরিবর্তনের বাতাবরণ তৈরী হতে শুরু করল।

২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে সেই পরিবর্তনের শুরু। মানুষ যে জনস্বার্থ-বিরোধী সিপিএম ও কুচক্রী কংগ্রেসকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তা স্পষ্ট হতে থাকল। পঞ্চায়েতের ৫১ হাজার আসনের মধ্যে মানুষের সমর্থন নিয়ে ৩৯ হাজার আসনে প্রার্থী দিল তৃণমূল কংগ্রেস। জয় এলো ২৯ হাজার আসনে। শুরু হল তৃণমূলের জয়যাত্রা। এর পর ২০০৯-এ লোকসভা আসনে নিজেদের পদক্ষেপ আরও স্পষ্ট করে রাজ্যে ভিত শক্ত করতে শুরু করলো তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরের বছরই পুর-নির্বাচন। কলকাতা পুরসভা-সহ ৮৭টি পুরসভার নির্বাচনে বাংলায় পরিবর্তনের সূচনা হল। তারপর ২০১১ সাল। মানুষের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে গণতন্ত্রের জয় হল। মানুষ আশীর্বাদ করে বাংলার ক্ষমতা তুলে দিল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে। মানুষের কাছে যে অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, শুরু হলো সেই প্রতিশ্রুতি, সেই অঙ্গীকার রক্ষার কাজ। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সিঙ্গুরের কৃষিজমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হল। বিল আনলেন জননেত্রী। কিছু আইনি প্রক্রিয়ায় সেই বিল আটকে গেল হাই কোর্টে। মামলা গেল সুপ্রিম কোর্টে।

তার মধ্যেই কিন্তু চলছে দলকে অনুশাসনে বাঁধার পালা। সঙ্গে সরকার চলছে বাংলার মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। একেবারে নিজের পরিশ্রমে মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে নিজের বুধ্ধিমত্তার জোরে একের পর এক সরকারি প্রকল্প ঘোষণা। ইতিমধ্যে একদিকে জঙ্গলমহল, উল্টোদিকে পাহাড়কে শান্ত করে ফেলেছেন বাংলার নেত্রী। এর পরই শুরু হল বাংলার মানুষের জন্য একের পর এক প্রকল্প নেওয়া। মানুষ কেন জননেত্রীর ওপর ভরসা রাখবেন না? একার পরিশ্রমে, একার বুধ্ধিমত্তায় আনলেন কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প। যা এখন গোটা দেশ, গোটা বিশ্বের কাছে মডেল। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরে-কিশোরীদের জন্য সবুজসাথী, যুবক-যুবতীদের জন্য এল যুবশ্রী। বেকারদের সাহায্যার্থে একাধিক প্রকল্প। সরকারি সহায়তায় ঋণ দিয়ে বেকারদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর পালা। মাথায় রাখতে হবে, বাংলার সরকারের ঘরে তখন আড়াই লক্ষ কোটি টাকার ঋণ। মানুষকে ঠকিয়ে বামফ্রন্ট রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে গিয়েছে সেই ঋণ। তার মধ্যে কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে বারবার দরবার করেও মিলছে না সুরাহা। এই সার্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের কথা জাতীয় স্টোরে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি মর্মে উপলব্ধি করলেন সেই মমতা বন্দোপাধ্যায়। বুঝলেন বাংলায় উন্নয়নের কাজ মসৃনভাবে চালিয়ে যেতে গেলে কেন্দ্রের ক্ষমতাকেও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তবেই বাংলার অধিকার রক্ষিত হবে। রক্ষিত হবে বাংলার প্রকৃত স্বার্থ।কারণ কেন্দ্র সরকার যেভাবে বাংলার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে, সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, যেভাবে একের পর এক প্রকল্পে রাজ্যের বরাদ্দ ছাঁটাই করছে, তার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজন কেন্দ্রে ক্ষমতা বদল। সেই প্রেক্ষাপটেই দেশজুড়ে সমমনোভাবাপন্ন শক্তিগুলিকে একজোট করে ফেডারেল ফ্রন্ট গঠনের ডাক দিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।

পরিস্থিতির দাবিতে শুরু হল বাংলার বাইরে পা রাখা। এ কথা না বললেই নয় যে, এই গোটা পথ এক হেঁটেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরা, ওড়িশা, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশও তৃণমূলনেত্রীকে আহ্বান জানাল। সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিন ভারতেও একইসঙ্গে বাড়ছে দলের গ্রহণযোগ্যতা। এই অবস্থায় রাজ্যে কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে অভিমান তৈরী হল। দলীয় কিছু নেতার বিরুদ্ধে সেই অভিমান নিয়েও ব্যবস্থা নিলেন জননেত্রী। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, মানুষের স্বার্থে লড়াই তাঁর প্রধান শর্ত। সেই নীতি থেকে তিনি সরবেন না। ফলে মানুষ সমস্যায় পড়ে এমন কোনও ঘটনা ঘটলে তিনি বরদাস্ত করবেন না। তাই মানুষের পাশে থাকতে হবে। তাদের সঙ্গেই চলবে উন্নয়নের কাজ।

মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দলকে অনুশাসনে বেঁধে, কি দূরদর্শিতায় জননেত্রী বাংলার ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন, তা বোঝা যাবে নেত্রীর নিরলস প্রয়াসে। রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি বেকার সমস্যা সমাধানে শিল্প যে কতটা জরুরি, মমতা তা বুঝিয়ে দিলেন।

বিশ্ববাংলা সম্মেলনের আয়োজন করলেন জননেত্রী। যেখানে আম্বানি থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বহু শিল্পোদ্যোগীকে আহ্বান জানালেন। মমতা বুঝিয়ে দিলেন কৃষির ওপর ভিত্তি করেই শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে। তবেই রাজ্যের উন্নয়ন দ্রুত সম্ভব। শুরু হল জননেত্রীর আহ্বানে রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনা। স্কিল ডেভেলপমেন্ট থেকে ছোট ছোট সহযোগিতার মাধ্যমে রাজ্যে শিল্পের বাতাবরণ তৈরী হতে থাকল। শিল্প-সম্ভাবনা আরও জোরদার হল। শিল্পের প্রয়োজনে বিদেশের মাটিতে পা রাখলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলার শান্ত পরিবেশে শিল্পের আরও নানা দিক খুলতে লাগল। বাংলার হাত ধরতে শুরু করলো বিশ্ব। বিশ্ববাংলার রূপ পেতে শুরু করলো রাজ্য।
পাঁচ বছরের এই সার্বিক প্রচেষ্টার সুফল হাতে নিয়ে যখন মানুষের সামনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, বিরোধী দলগুলি একজোট হল। জোট বাঁধলো এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম। শুরু হলো লাগাতার ষড়যন্ত্র, কুত্সা, মিথ্যা প্রচার। মানুষকে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার চূড়ান্ত অপচেষ্টা। রাজ্যকে অশান্ত করে দেয়ার চক্রান্ত। রাজ্যে সেই রাজনৈতিক অশান্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে জনমতের ঝড় মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আবার পৌঁছে দিল মসনদে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যে আদপে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য, তার প্রমাণ দিয়ে মানুষই বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা মমতা বন্দোপাধ্যায়েই আস্থা রেখেছেন। কোনও অলীক কল্পনা নিয়ে কোনও ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে চান না মানুষ।

শুরু হল নেত্রীর দ্বিতীয় ইনিংস। আবার প্রতিষ্ঠিত হল গণতন্ত্র। দুর্নীতি, অপশাসন, মানুষের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই শেষ করে, মানুষের আশীর্বাদে জয় ছিনিয়ে এনে ষড়যন্ত্রের বাধা পার করে, রাজ্যের জন্য উন্নয়নের ডালি নিয়ে দলকে এক সুশাসনের মন্ত্রে বেঁধে বাংলার নতুন সূর্যোদয়ের দিকে চলেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সরকার ও দলকে চালানোর ক্ষেত্রে এবার তিনি আরও কঠোর। এই ধাপেই সুপ্রিম কোর্টের রায় এনে দিল নতুন জয়। জীবন বাজি রেখে সিঙ্গুরের জন্য যে লড়াই জননেত্রী লড়েছেন, জয় হয়েছে সেই লড়াইয়ে। কৃষকদের হাতে ফিরেছে জমি। সঙ্গে আরও সম্ভাবনাময় হচ্ছে শিল্প-পরিস্থিতি। যা তাঁর একার কৃতিত্ব।

 

 

রোম -জার্মানির রেডারে বাংলা – মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

২ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর সকাল। আটটি দিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বক্ষণের সফরসঙ্গী হিসেবে আমার থাকার সুযোগ ঘটেছিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে এমিরেটসের বিমানে কলকাতা-দুবাই প্রথমে পৌঁছনো হয়। সেখানে আমরা একত্রে ছিলাম। মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, সস্ত্রীক মুখ্যমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি গৌতম সান্যাল, রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। সঙ্গে ছিল একদল সাংবাদিক বারো সংখ্যায়।

আমরা দুবাই বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর হাই কমিশনের পক্ষ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানানো হয়। তাঁকে আলাদা করে সেরিমনিয়াল লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রদূত স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত প্রতিনিধিকে একত্রিত করে একটি বাসে করে আমরা উপস্থিত হই। কিছুক্ষনের মধ্যেই খবর আসে ভারতবর্ষের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ খুব নিকটে সেরিমোনিয়াল লাউঞ্জে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষা९ করতে চান। তারপর সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংলগ্ন একটি বিরাট কক্ষে যেখানে সুষমা স্বরাজ নয় সদস্যের এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন। দিল্লি থেকে এসে তাঁরাও একই সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের যাত্রা ছিল ৪ সেপ্টেম্বর রোমের ভ্যাটিকান শহরে মাদার টেরিজার সন্তায়ন আখ্যায় আখ্যায়িত করার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। সুষমা স্বরাজ এবং তাঁর সঙ্গে আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যে সাংসদরা প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন তাঁরা সকলে মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে উচ্ছসিত হন। দীর্ঘ ৪৫ মিনিট কথোপকথন। আলাপ-চারিতা হয়। প্রতিনিধি দলে জনৈক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও ছিলেন। সেখান থেকে একই বিমানে আমরা সকলে মিলে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হই।

ইউরোপের বুকে ভারতের এক বড় প্রতিনিধি দল পৌঁছেছে। আরও ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি কলকাতা শহর রোমে উঠে আসছে। ২ তারিখে সময়সূচিতে রাত্রি হয়ে যাওয়ায় সকলে যে যাঁর মতো নৈশভোজ সেরে ঘরে চলে যায়। ৩ তারিখ সকালে যখন আমরা সকলে প্রাতরাশের ঘরে আলোচনা করছি, নিজেরা একবার ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পরিবেশটা একবার দেখে আসা যায় কখন। তখন দেখি হোটেল থেকে দু’কিলোমিটার দূরে ভ্যাটিকান সিটি চার্চ পরিভ্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে আসছেন। তাঁর এই ততপরতায় আমরা যুগপ९ বিস্মিত হয়ে পড়েছি। এর আগেইতালিও দূতাবাসের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দফতর থেকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যান্য প্রতিনিধিদের ঘর বরাদ্দ নিয়ে এক অন্যায় এবং অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু বিদেশের মাটিতে দেশের রাষ্ট্রদূতভবনের এই অন্যায় কার্যকলাপ মেনে নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী প্রচুর ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে বরাদ্দকৃত ঘরেই অবস্থান করেন। যে ঘরে তাঁকে স্থান দেওয়া হয়েছিল তা দেখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল যিনি ওই হোটেলে ছিলেন, তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমার ঘরের থেকে এই ঘর ছোট শুধু তাই নয়, একই ঘরের সঙ্গে যেখানে শোয়া এবং বাথরুম যেভাবে মুখোমুখি সংলগ্ন।

এমনকী , যেভাবে ঘরে বসার অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেই তা দেখে আমি বিস্মিত।কিন্তু যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী এসব বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না তাঁর নিজের জীবন নির্বাহের মধ্যে দিয়ে বারবার প্রমান করেছেন। তাই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন চার তারিখের কর্মসূচীতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানকে সারা বিশ্বব্যাপী মানুষের সামনে কীভাবে তুলে ধরবেন।

ওই দিনই বিকেলে হোটেলের লনে আমরা গোল হয়ে বসলাম। মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব দিলেন হোটেল থেকে ভ্যাটিকান সিটি উ९সবস্থল পর্যন্ত আমরা একত্রে গান গাইতে গাইতে যাব। প্রথমে বিষয়টি শুনে অনেকে ভ্রুকুঞ্চন করেছিল। ইটা কি আদৌ বাস্তবে সম্ভব। শুরু হলো গান বাছাইয়ের পর্ব। একটি, দুটি করে চারটি গান বাছা হল। শুরু হল রিহার্সাল। নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা কখনো গান গাননি তাঁদেরও দেখা গেল ঠোঁট নাড়তে। গানের নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরেই রিহার্সাল শুরু হয়। ততক্ষনে হোটেলে আসা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা অধীর আগ্রহে আমাদের দেখতে জমা হতে শুরু করেছিলেন। প্রায় ৯০ মিনিট চলে গানের রিহার্সাল। গাঙ্গুলিকে লিখে প্রত্যেকের হাতে একটি করে অনুলিপি তুলে দেওয়া হল। যাঁরা গাইতে না পারবেন, তাঁরা যেন অন্তত সুর মেলাতে পারেন। গলায় একটা স্বেচ্ছাসেবকের মতো একটা করে বিশেষ ব্যাজ ঝুলিয়ে নেওয়া হল। যাতে লেখা হল ‘We are from the city of mother, Kolkata’। তার উপরে লেখা ছিল ’BENGAL’ । খুব সুসজ্জিত ছিল ব্যাজগুলি। প্রস্তুতি সম্পন্ন। চূড়ান্তভাবে যখন রিহার্সাল পর্ব সম্পন্ন হচ্ছে তখন মুখ্যমন্ত্রী সন্তুষ্ট হলেন। নির্দেশ দিলেন, পরের দিন চার তারিখ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে যেন প্রস্তুত হয়ে তাঁর নেতৃত্বে রওনা হই।

৪ তারিখ সকাল। সাড়ে আটটাতেই যাত্রা শুরু হলো মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে। গান করে রোমের শহর ভ্যাটিকানের দিকে আমাদের যাওয়া। ততক্ষনে ভ্যাটিকানে চার্চের সামনে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে গিয়েছে। ততক্ষনে সারা বিশ্ব থেকে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সারা পৃথিবী থেকে ১৮৫ জন বিশপ উপস্থিত। সারা শহরে একটা আলাদা মাধুর্য। আর তার মধ্যে দিয়ে রোমের রাস্তায় নেমেছে এসেছে কলকাতা, নেমেছে এসেছে বাংলা। নেমে এসেছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অত্যন্ত রুচিবান, সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। যাঁরা গান করতে করতে যত এগিয়েছে, রাস্তার দু’পাশের মানুষ অপার বিস্ময়ে লক্ষ করেছে। ‘মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে।..’ গানটি যখন গাওয়া চলছে তখন আমরা ভ্যাটিকান সিটির মুখে পৌঁছে গিয়েছি। কানায় কানায় পরিপূর্ণ পরিবেশ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চার্চের মাথার উপর ঝুলছে মাদার টেরিজার হাতজোড় করা মিষ্টি হাসির নিদারুন সুন্দর প্রতিকৃতি।সুসজ্জিত মঞ্চ।

অতর্কিতে আমরা দেখলাম মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধান, যাঁদের আমন্ত্রণে মুখ্যমন্ত্রীর ভ্যাটিকান সিটিতে যাওয়া। তাঁদের প্রধান সিস্টার প্রেমা অন্তত একশো মিটার মঞ্চ থেকে নিচে নেমে এসে সমস্ত পুলিশ বেষ্টনীকে সরিয়ে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন মূল মঞ্চের দিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনই সিস্টার প্রেমাকে বললেন, পুলিশদের বলে দিন আমার সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলের সকলেই যেন মূল মঞ্চে বসার স্থান পান। আমাদেরও সসম্মানে নিয়ে গিয়ে মূল মঞ্চের পিছনের সারিতে যা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে। আমরা সকলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আসন নিয়ে বসলাম। সকাল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা। দু’ঘন্টার কর্মসূচি ছিল। মাঝখানে একটি অংশে বাংলাতেও প্রার্থনা করা হল। তখন মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে ভারতবর্ষের আর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ যার এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলেন তাঁদের উচ্ছাস চোখে পড়ার মতো ছিল। সমস্ত কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়ার পর মহামান্য পপ-সহ অন্যান্যদের নমস্কার বিনিময় করে মমতা বান্দ্যোপাধ্যায় ফিরে আসেন আমাদের কাছে। প্রখর রৌদ্রতাপ। অভাবনীয় উষ্ণতা। এর মাঝে কিছু বিদেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জনৈক প্রৌঢ়া, তার নাম ছিল ন্যান্সি, একটি হুইল চেয়ার বসিয়ে তাঁর স্বামী তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গলায় কাশি আটকে গিয়ে প্রায় দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসহায় অবস্থায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক স্ত্রীর গলায় হাত দিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ত९ক্ষণা९ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সহযোগিতা করলেন। জলের ছিটে দিলেন মুখে। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকা ওষুধ বের করে তাঁকে খাওয়াতে বললেন এবং তাঁকে অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হাসপাতালের পাঠানোর ব্যবস্থা নিজে দাঁড়িয়ে করলেন। এর মধ্যে মনে হচ্ছিল যে রোম যেন কলকাতা হয়ে গিয়েছে।

সেখান থেকে আমরা ফিরে এলাম। সকলে নিদারুন খুশি। মুখ্যমন্ত্রী এর মধ্যেই কলকাতায় খোঁজ নিলেন মাদার হাউসে। অত্যন্ত সুন্দরভাবে কর্মসূচি পালিত হয়েছে এবং সমাধিক্ষেত্রে ১০৪টি গোলাপ ফুলের পুস্পস্তবক তাঁর তরফ থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোমে বসে থাকলেও বাংলার দিকে তাঁর মন সবসময় পড়ে ছিল। ইতিমধ্যে তিনি একটি ভালো সংবাদ পেয়েছেন। তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস, সর্বভারতীয় ভিত্তিতে সর্বভারতীয় সীকৃতি পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই কথা বলা হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি এই নির্বাচন কমিশনের কাছে কাগজ জমা দিতে গিয়েছিলাম। কতকিছু পদক্ষেপ অতিক্রম করে আজ দল সর্বভারতীয় দলে উন্নীত হয়েছে। টুইট করলেন, উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। চোখের মধ্যে এক নিদারুন তৃপ্তি লক্ষ করলাম। মনে হল এমনভাবে অসম্ভবকে একক শক্তিতে কেউ সম্ভব করতে পারে যা বোধহয় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে স্বপ্নেও ভেবে ওঠা মুশকিল।

পরের দিক সকলেই বায়না ধরলেন, দিদি রোমে শহরটা একবার দেখতে যেতে হবে। দু’ঘন্টার ছোট পরিক্রমা। ইতিহাস বিজড়িত রোমে শহর। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট থেকে শুরু করে যে বাড়ি থেকে মুসোলিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদদের যে স্থান তাঁরা রক্ষা করছেন ‘ওয়াটারহাউস’ নাম দিয়ে। সে সব পরিভ্রমণ করলেন, ঘুরলেন, দেখলেন। খুব পছন্দ হল শহরে কোনও ‘হাইরাইজ’ বিল্ডিং দেখলেন না। তা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে, উচ্চতার মধ্যে। খুব শৃঙ্খলাপরায়ণভাবে শহরের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ। সব দেখে মন্তব্য করলেন, আমাদের দেশেও এমনটা হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের জনসংখ্যা এই পরিবেশ কখনও গড়ে উঠতে দেবে না। একটা পুরো দেশ ইতালিতে যে পরিমান জনসংখ্যা, একটা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা তার থেকে বেশি। ভারতবর্ষের কথা তো বাদই দিলাম। রোমে সফর চার্চের অসাধারণ শিল্পের প্রতিফলন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অতীতের উপস্থিতি এই রোম শহরের সঙ্গে কিভাবে জড়িয়ে রয়েছে তা প্রতি পদে পদে পরখ করে দেখা যায়।

পরের দিন, আমাদের পৌঁছতে হবে জার্মানি। মিউনিখ শহরে। আমাদের রোম থেকে চলে যাওয়া কথা ছিল অন্যত্র। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সেই কর্মসূচি বাতিল করতে হল। সেই সফরসূচিতে জার্মান এয়ারলাইন্সের বিমান লুফতহানসায় করে এসে পৌঁছলাম মিউনিখ। সন্ধ্যাবেলা। সেখানে দেখলাম বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত আছেন অর্থমন্ত্রী ডঃ অমিত মিত্র এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেখান থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন রাত দশটা।

পরের দিন সকাল আটটাতেই অর্থা९ ছ’তারিখ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ডঃ অমিত মিত্রর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত গাড়ির প্রধান কার্যালয় বিএমডব্লিউ-তে। ন’টায় নির্ধারিত একটি বৈঠকের কর্মসূচির খবর পান। সেখানে ডঃ মিত্রের সঙ্গে মুখ্যসচিব, অর্থসচিব, বন্ধন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এবং আমি। আমরা উপস্থিত হলাম। বিএমডব্লিউর সিইও-সহ ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দু’ঘন্টা ব্যাপী বৈঠক। আমি নিজে যেটুকু বুঝলাম যে, বিএমডব্লিউ কর্তৃপক্ষের কাছে এখনও যে ভারতবর্ষের কতগুলি স্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে সেগুলি হচ্ছে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, গুরগাওঁ। কথা প্রসঙ্গে ওঁরা এটা জানালেন যে কলকাতাকে আমরা আমাদের মানচিত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। মানচিত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে সেটা চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী আদালতের যে রায় আমাদের টাটার ন্যানোকে নিয়ে ঘোষিত হয়েছিল সেকথাটিও বিএমডব্লিউ কর্তৃপক্ষকে আমাদের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল। এই ভেবেই জানিয়ে দেওয়া হল, যে তাঁদের মনের মধ্যে যাতে এই ধারণা কখন না হয় সেখানে শিল্পের পরিবেশ আঘাত খেয়েছে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেভাবে শিল্পোদ্যোগীদের নির্দেশ দিয়েছে সেই কোথায় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শুরু থেকে বলে এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে এটা উদ্ধার হল যখন আমরা তাদের বিশাল অট্টালিকার উপর থেকে বিএমডব্লিউর ফ্যাক্টরি দেখছি শুনলে আশ্চর্য হতে হয় তাঁদের ফাক্টরিটি তৈরি ১৫০ একরে। কিন্তু টাটা মোটরস এখানে এক হাজার একর জমি নিয়েছিল। বিরোধী দলে থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ছ’শো একর পর্যন্ত করুন। সেই বিষয়টি তাঁরা অধীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কলকাতা শহরের পার্শবর্তী এলাকার যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান থেকে কলকাতা শহর আসা-যাওয়ার যে ব্যবস্থা, কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন প্রান্তে রাজ্য সরকারের হাতে যে এক লক্ষ দশ হাজার একরেরও বেশি জমির যে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক আছে। যেখান থেকে ইচ্ছা করলেই জমি নিয়ে কাজ করা যায়। সব তাঁরা অধীর আগ্রহে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং অদ্ভুতভাবে আগামী পাঁচ বছর পর দেশের পরিবহন ব্যবস্থা কোন দিকে মোড় নিতে পারে সে সম্পর্কেও তাঁরা তাদের একটি উদাহরণ দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম প্রায় ন্যানোর থেকে একটু ছোট গাড়ি বিএমডব্লিউ বের করেছে। জার্মানির রাস্তায় চলছে। পিছনে দুই, সামনে এক ছোট্ট একটা গাড়ির পিছনের ছাপটা বিএমডব্লিউর। দামটা সতেরো লক্ষ টাকা। কিন্তু মানুষ গাড়িটাকে গ্রহণ করেছে। মোটরবাইক তৈরী করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রোম থেকে জার্মানির উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে আসছিলেন তখন তাঁর সামনে যে ‘পেট্ৰোল’ গাড়ি দেয়া হয়েছিল, তা ছিল দুটি মোটরবাইক। তা ছিল বিএমডব্লিউর। মুগ্ধ বিস্ময়ে মুখ্যমন্ত্রী তখনই বলছিলেন, কলকাতা শহরে ট্রাফিক পেট্রোলে মানে ভিআইপি পেট্রোলের জন্য যে গাড়িগুলি চলাচল করে সেগুলিকে বদলে দেওয়া হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে এবং সেই গাড়ি চালকদের প্রতি অন্যান্য গাড়ি চালকদের যে সম্মান প্রদর্শন, যেভাবে তারা গাড়ি রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, না দেখলে ভাবা যায় না। অন্য গাড়িতে তো চারজন করে বসতে হয়। এতে একজন করে লোক দু’টো করে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই গাড়ি দেখলাম। অমিত মিত্রর সঙ্গে যখন আমরা তাঁদের শোরুম ভিজিট করতে গেলাম অফিসের নিচেই সেই বাইকের উপর তাকে চড়িয়ে বসালাম। একেবারে নতুনভাবে বেরিয়ে এসেছে যে বিএমডব্লিউতে অমিত মিত্র, আমি দুজনে বসলাম। ফটোগ্রাফার ও আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের ছবি তোলার সুযোগ দিতে। সাংবাদিক বন্ধুরা চতুর্দিকে ঘুরেফিরে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখলেন। ফিরে আসলাম এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে। জানতে পারলাম বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ বেঞ্জের মধ্যে সারা বিশ্বজুড়ে এখন প্রচুর প্রতিযোগিতা। কিন্তু অটোমোবাইল শিল্পে জার্মানির অগ্রগতির কথা সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। মুখ্যমন্ত্রীকে এসে জানালাম। হঠা९ করে অধিক উচ্ছাস প্রকাশ করা, কোনও কিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার আগেই প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য দেওয়া এসব থেকে তিনি এখন অনেক দূরে আছেন। আমি এখনও মনে করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিশ্বাসই করছেন যে তিনি চেষ্টা করে যাবেন। তাঁর চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আরও সদর্থক উদ্যোগ, আরও সুচিন্তিত ভাবনার প্রতিফলন এবং বাস্তবের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য সম্ভব এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত মেপে পা ফেলবেন।

ওই দিনে বিকেলে তিনি ভারতবর্ষ থেকে যাওয়া বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। সেখানে মুকেশ আম্বানির প্রতিনিধিও ছিলেন, রতন টাটার প্রতিনিধিও ছিলেন। দেশের আরও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ছিলেন। পরের দিন যে চূড়ান্ত বৈঠক মিউনিখ শহরে হবে সেখানকার বিস্তৃত কর্মসূচি নিয়ে সেখানে আলাপ আলোচনা হল। পরের দিন সেখানে পৌঁছে যাওয়া হল।

সাত তারিখ সকাল। আমাদের সেখানে পৌঁছে জার্মানির ক্যাবিনেট মন্ত্রী বৈঠকে যোগ দিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করলেন। পরবর্তীকালে বৈঠক চলার সময় পাঁচজন জার্মানির কনসার্নের প্রতিনিধি, পাঁচজন বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগী ও আমাদের ভারতীয়দের পক্ষে পাঁচজন। মোট দশজন সেখানে বক্তব্য রাখলেন। মুখ্যমন্ত্রী পরবর্তীকালে তাঁর সাবলীল ভঙ্গিতে যে বক্তব্য রাখলেন তা এক কথায় অত্যন্ত প্রাণস্পর্শী। টাটার প্রতিনিধি যখন এসে বললেন সরকারের কাছ থেকে টাটা স্টিল প্রচুররকম সহযোগিতা পেয়ে থাকে। মুকেশ আম্বানির প্রতিনিধি যখন বললেন আগামী দিন পশ্চিবমবাংলাই হচ্ছে মূল লক্ষ পথ। এটাই আমাদের চেয়ারম্যান বিশ্বাস করেন। তখন আমরা গর্ব অনুভব করছি।এবং জার্মানিতেও বহু সংখ্যায় ভারতীয় কীভাবে শিল্পের সঙ্গে, কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন তা সেখানে গিয়ে একবার নজর কাড়ল। আমার মনে হয় বাংলা থেকে যে বক্তারা সেখানে বক্তব্য রাখলেন যে উত্সাহ, যে উদ্যোগ নিয়ে তাঁরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিলেন তাতে দেশ স্বাধীনতার পর নিজের রাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এমনভাবে বাংলাকে তুলে ধরতে কখনও দেখা যায়নি। একসুরে, একটাই কথা, ‘বাংলায় বিনিয়োগ করুন, বাংলায় আসুন’। সকলের একটি নিদারুণ সহযোগিতায় একটি সফল সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, যে বাংলা আগামী দিনের সদর্থক পদক্ষেপে শিল্পায়নের দিকে এগোবে এবং ছোট মাঝারি শিল্পের সঙ্গে বড় শিল্পের স্থাপনের দিকেও তাদের নজর থাকবে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না এবং জার্মানিকে তাদের মন্ত্রীর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন যে জানুয়ারি মাসে যে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন আবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে তাতে যেন জার্মানির ভালো সংখ্যায় প্রতিনিধিরা যেন উপস্থিত থাকেন। বিএমডাব্লিউয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওই সম্মেলন সম্পন্ন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করলেন। আমার যা মনে হয়েছে যতটুকু ঘটছে তাতে আপাতত সেটুকুর মধ্যে গোটা বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্চনীয়। অতিরিক্ত আশার ফুলঝুরি দেখিয়ে পরবর্তীকালে কোনও পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হল না সেই পদ্ধতিতে যাওয়া কখনওই ঠিক নয়। অতিরিক্ত উচ্ছাস প্রদর্শন করে বাস্তবের সঙ্গে তার সাযুজ্য বা মিল রইল না এমন রাস্তাতেও হাঁটা ঠিক নয়। আর সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী কোন ঘটনাকে একটা অতিরিক্ত উচ্চতায় তুলতে চাইলেন না বলে তিনি একটা অসাধারণ মনোভাব নিলেন। যাতে প্রমাণিত হল তিনি তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাংলার শিল্পায়ন চান। কিন্তু তার জন্য কোনও এমন উচ্চতায় বিনা কারণে তুলতে চান না যা পরবর্তী কালে সমালোচকদের মুখ খুলতে সহায়তা করে।

ফিরে আসার পালা। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী সর্বোচ্চ পদযাত্রা একদিকে ১৬ কিলোমিটার। আসার আগের দিন আট তারিখ। এই একটি বিষয়ে তাঁর এক সহযোগীকে রোজ দেখতে পাওয়া যেত না। পালা পরিবর্তন করে হাঁটতে হত। কিন্তু তিনি থাকেন প্রতিদিনই একই রকম। তিনি চলেন, বিভিন্নভাবে মানুষ তাঁর পাশে আসেন। হাঁটতেই থাকেন। তিনি চলতেই থাকেন। জীবনের আরও একটি নাম তো চলা। আর সেই সেই চলার পথে তিনি কখনও খামতি দিতে চান না। এই কয়েকদিনের সফরে থেকে দেখলাম তাঁর মানবিকতার দিক। সকলকে নিয়ে একটি পরিবারের মতো থাকার দিক। বিশ্ব বাংলা যে একটা শুধু স্লোগান নয়, বিশ্ব বাংলা যে একটা উপলব্ধি, বোধ। বিশ্ব বাংলা রোম এবং জার্মানির মতো দু’টি স্থানে তার উপস্থিতি প্রমাণ করে সার্থকভাবে ফিরে এল এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আরও ব্যাপকভাবে চালু থাকবে। আর সে কারণেই আগামী নভেম্বরে আবার ভারত-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর সকলে মিলে আরও বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে বাংলার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্ব দেবেন। যা সম্পন্ন হতে চলেছে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। বিমানে ফেরা। মিউনিখ-দুবাই-কলকাতা। সেখানেও পায়ে হাঁটা। সকলকে তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে দেওয়া। ফেরার সময় এমিরেটস বিমান কর্তৃপক্ষের অন্যতম কর্ণধার স্বয়ং এসে মুখ্যমন্ত্রীকে এবং সদলবলে তাঁর সমস্ত টিমের সহযাত্রীদের একসঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। বিমানবন্দরে দুবাইয়ের মতো অনেক কড়াকড়ির ব্যবস্থা। যেখানে এই সম্মান তাঁরা সুষমা স্বরাজকেও দেননি বলে আমরা জানলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তা দিলেন। বিমানের মধ্যে বিমান সেবিকাদের ছবি তোলার নিদারুণ আগ্রহ। মিউনিখ বিমানবন্দরেও ভারতীয়দের মধ্যে এমন এক প্রচলিত মুখ যা সত্যিই আমাদের গর্বের এবং অহংকারের।

 

Like Mahatma Gandhi, Mother Teresa – now Saint Teresa – was deeply religious and yet beyond religion: Derek O’Brien

Of the hundreds of Catholic orders across the world, only one has an office in the Vatican itself: the Missionaries of Charity, founded by Mother Teresa in Kolkata. Of the thousands of saints recognised by the Catholic church, a formal induction ceremony, as part of the canonisation process, has been reserved for only about 800. On September 4 Mother Teresa joined them. She will became the 10th St Teresa, St Teresa of Calcutta/Kolkata, and like the others distinguished by the city she is most identified with.

This background is important to understand why the canonisation of Mother Teresa is a special event even within the narrow space of the Catholic church’s conferring of sainthood on its most revered. Some have been so honoured centuries after death. Joan of Arc was murdered in the early 15th century and canonised in the early 20th century.
Mother Teresa is being canonised merely 20 years after her passing. She is recognised as special, both within the Catholic church and outside. She is recognised as somebody who always introduced herself as an Indian, and yet rose above national boundaries to become a global icon.

This is reflected in how her canonization became a truly a truly event. From Bengal we were lead by our Didi. There were other delegations too from across the world (including one lead by the External Affairs Minister and another by the Chief Minister of Delhi ) but it must be said the warmth and love showered on Mamata Di by the Missionaries of Charity was very, very special. In an unprecedented gesture, Sr Prema walked down 150 meters from the main altar, took Didi gently by the hand and walked up the aisle as pilgrims applauded spontaneously. What a moment! Throughout the two and a half hour service, the Chief Minister of Bengal was seated between Sr Prema, the successor to Mother Teresa and another senior sister from the Missionaries of Charity.

Mamata Banerjee first met Mother Teresa in the early 1990s in the context of disquieting religious violence in Kolkata. A few months ago – shortly after the assembly election results in Bengal – Sister Prema, worldwide head of the Missionaries of Charity, visited the chief minister and invited her to the ceremony. The offer was gratefully accepted. I was fortunate enough to be asked to accompany Mamata Banerjee. In my 13 years with Trinamool, it was one of the most emotional journeys I have made with Didi.

Others made the journey to the Vatican as well. Some 150 pilgrims from Kolkata, and 15 inmates (i prefer the word “residents”) of the homes for the poor that the Missionaries of Charity run in the city, and several others touched by Mother’s life and by the 5,000 nuns and brothers of her order, across 130 countries, either came to Rome or watched on television.

Not all of them are Catholic or even Christian. Like Gandhi, Mother Teresa was deeply religious – and yet beyond religion. When she picked up the sick and the indigent, literally off the street, cleaned and tended to them with her own hands and took them “home”, she didn’t stop to first ask for the religious identity of the person. “Yes, I convert,” Mother once said, “I convert Hindus to become good Hindus, I convert Muslims to become good Muslims, I convert Christians to become good Christians.” While remaining true to the tenets of her faith, she was enlightened enough to appreciate the pluralism of our society.

My association with Mother Teresa began in the early 1970s, in class VIII. Father Bouche, a Belgian priest who taught us in school, encouraged us boys to make paper packets (thongas, as we call them in Kolkata) for use at Shishu Bhawan, the children’s home the Missionaries of Charity ran.

Those of us not adept at making packets (like me) were asked to collect newspapers at home and from neighbours. The experience left an impression on us; we felt we were being useful. In college and as a working person, i volunteered at Shishu Bhawan and was lucky to meet Mother often. Those are fulfilling memories i still cherish.
We can all disagree with some aspect or the other of Mother’s life. She would not be happy with my views on abortion or divorce. The criticism that the Missionaries of Charity did not consider psychological issues of the sick and the infirm or provide for palliative care – a specialised area now – for the terminally ill has been addressed only in recent years.

Nevertheless, when we assess her life, the good she did far, far outweighs the minor quibbles. Let’s not get engrossed in those quibbles. Let’s celebrate our Mother and her moment.

 

সংগ্রামই জীবন: অভিষেক বন্ধোপাধ্যায়

যত মত তত পথ, যত্র জীব তত্র শিব, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, উক্তিগুলি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের। সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান মানবজীবন এবং তাঁর বাণী। প্রাচীন সভ্যতার তীর্থ ভারতে দূর অতীতের শ্রীমদভাগবতগীতাতে আছে ভগবান যুগে যুগে ধর্মের গ্লানি বিমোচন, দুর্বৃত্তের বিনাশ ও সত্য ধর্মকে প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষার জন্য আবির্ভূত হন অবতার হয়ে।

আধুনিক বিশ্ব পরিস্থিতি ও ভারতীয় সভ্যতার মহিমাময় আদর্শের অবক্ষয় ও অপমৃত্যুর সংকট মুহূর্তে পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণের আবির্ভাব এমন একটি বাস্তৱ ঘটনা।

জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যৌবন। যৌবন জীবনের একটি সন্ধিক্ষণ, বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের সময় এটা। যুবকরা শুধু সমাজের নয়, সমগ্র জাতির বলিষ্ঠতম অংশ বিশেষ।তাই যুবকদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয় যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে। আমাদের সমাজ সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী।তবু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর চতুর্দিকে কুসংস্কার, জাতিভেদ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দারিদ্র ও নিপীড়ন। এসবের মধ্যেই মাঝে মাঝে নেমে আসে প্রকৃতির অভিশাপ ক্ষরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি। ফলস্বরূপ দেখা যায় কত মানুষের গৃহহীন দুরবস্থার চিত্র। এই অবস্থায় সেবাদর্শের অনুভব নিয়ে জাতির বলিষ্ঠতম অংশ অর্থাৎ যুব সমাজ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে আর কে আসবে।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ত্যাগ বৈরাগ্যই ভারতের সনাতন আদর্শ। সাহস, আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজসেবাই মুক্তির পথ। স্বামীজীর উদাত্ত ঘোষণা “মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করার জন্য, তাকে অনুসরণ করার জন্য নয়। শিবজ্ঞানে জীব সেবা।” আমরা যুবকরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানব জীবন ফুলের পাপড়ি বিছানো পথে চলে না, সংগ্রামই জীবন। বর্তমানে জীবন দারুন প্রতিযোগিতাপূর্ণ।

বর্তমানে নিজের ঘর নিজেকেই বাঁধতে হয় তাই পৌরুষই যুবকের শ্রেষ্ঠ মূলধন। পৌরুষ অর্জিত হয় গভীর মনোযোগে, নিরন্তন অভ্যাসে, নিরলস কর্মে, সময়নিষ্ঠায়, এবং বিনম্র আনুগত্যে।বলা বাহুল্য এগুলোই শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতারই স্বর্ণ ফসল। পৌরুষ অর্থে বীর সংকল্প, সুক্ষ বিচার বুদ্ধি, অনুশীলন ও সৃজন শক্তি, কর্মনিষ্ঠা, চিত্তের সুকুমার বৃত্তিগুলির পরিচর্যা ও পরিস্ফুটন, লোক ব্যবহারে সৌজন্য, শিষ্টতা ও সামাজিক বোধ, এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে সচেতনতা প্রভৃতির সম্মিলিত রূপটি পৌরুষ বা পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব। যৌবনেই এগুলো আয়ত্তের প্রকৃষ্ট সময়। আর তা শৃঙ্খলাবোধ বা নিয়মানুবর্তীতারই আশীর্বাদ। দায়িত্বচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ যুবক দেশ ও জাতির গৌরব। যৌবন তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে ভরপুর। শক্তি ও উদ্দীপনার মিলিত প্রয়াসে যুবকদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে দেশ ও সমাজের কল্যানে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা যুবকরাই ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের স্রষ্টা। বর্তমানে দেশের নাগরিক। আমাদেরই সমৃদ্ধ ভারত গঠন করতে হবে।

আমাদের যুবকদের বুঝতে হবে রাজনীতিতে কি? জীবনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জনে আর দশটা বৃত্তির মতো রাজনীতিও যেন একটা পেশা মাত্র, এ পেশায় আদর্শ ও অনুভূতির চেয়ে কূটনৈতিক পারদর্শিতায় বেশি প্রয়োজন, সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতি ক্রমশ এই তাৎপর্যই লাভ করতে শুরু করেছে। আজ তাই রাজনীতি বা রাজনীতিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অর্থাৎ জনসাধারণের তেমন শ্রদ্ধার ভাব নেই। যুবকদের এটাও বুঝতে হবে রাজনীতি কোনো পেশা নয়। স্বদেশসেবার পরম আদর্শ রাজনীতি সম্মান দেবে, সমাজে বিত্ত ও প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করবে, এই পেশাদারি মোহ থাকলে চলবে না।

মহাত্মা গান্ধী যেমন রাজনীতিকে বলেছেন, ‘ধর্ম’, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও তেমনই রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘সম্মিলিত সাধনা’ তথা ‘Collective Sadhana’ নামে। ধর্ম বা সাধনার আবেদন পেশাদারিতে নয়-আদর্শানুরাগের নিষ্ঠা ও হৃদয়ের অনুভূতিতে। যুবকদের মনে রাখতে হবে রাজনীতি পেশা নয়-আদর্শ ব্রত। মানুষের উপকারে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। রাজনীতিকদের মন যখন আদর্শানুরাগের অনুভূমিততে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন মান যশ প্রতিস্ঠার কোনোও আকাঙ্খা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না। আদর্শানুরাগ, জানসেবাব্রতীর জীবনকে যখন সুরভিত করে তোলে তার জীবন তখন দুর্জয় প্রচেষ্টায় দুঃসাহসিক অভিযান হয়ে ওঠে নিঃশঙ্ক ও নির্ভীক। জেনে রাখবে আদর্শের মৃত্যু নেই, আদর্শ-মৃত্যুঞ্জয়ী।

আমাদের দেশে শত শত মহাপুরুষ জন্মেছেন অথচ তাঁদের আবির্ভাব সত্ত্বেও আজ দেশ কি শোচনীয় অবস্থায় পরে আছে। জাতিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিদের কোনো স্বার্থকতা নেই-একথা আজ আমাদের সকলকে বুঝতে হবে আর এজন্যই আজ চাই ‘সম্মিলিত সাধনা-Collective Sadhana’।

আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব বিভিন্ন দেশে ও কালে কালে বহু উন্নত জাতি ও সভ্ভতার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আজ সেসব দেশের ভূগোল বেঁচে আছে বটে, কিন্তু ইতিহাস স্থানলাভ করেছে প্রত্নতত্ত্বের জীর্ণ পাতায়। যেমন মিশর দেশটি আছে, পিরামিডও আছে কিন্তু অতীতের মিশরের প্রানধারা বেঁচে নেই ; ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান আছে কিন্তু ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নেই ; তেমনি গ্রিস আছে গ্রিসের স্থাপত্য আছে কিন্তু গ্রিক সভ্যতার আত্মা আজ বেঁচে নেই। কিন্তু শত বিপর্যয়ের মধ্যেও ভারতবর্ষের জীবনস্রোত অবিচ্ছিন্ন রয়েছে। হাজার হাজার বছর আগেকার অর্থাৎ অতীতকাল থেকে আজকের দিনেও ভারতবাসীর জীবনে ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারা অবিচ্ছিন্ন রয়েছে।

যৌবন শক্তি চির অশান্ত, চির অবুঝ। অকারণে ঔদ্ধত্য, অপ্রয়োজনে দুর্বার বিদ্রোহ, চির-চাঞ্চল্যের উদ্দাম প্রানধারার ঊর্মিমুখর অপরিমিত উচ্ছাস-ইটা যৌবনের ধর্ম। যৌবন ভাঙতে পারে আবার গড়তেও পারে, আত্মবিলোপ করতে পারে, আবার আত্মবিকাশও করতে পারে। যৌবনের এই ধর্মকে স্মরণ রেখেই যুব আন্দোলনের মূল আহ্বান হওয়া উচিত বন্ধন থেকে মুক্তি, সংস্কার ও চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মানবতা বিরোধী স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান।

স্বামীজীর ভাবাদর্শে একাগ্র চিত্রে স্মরণ মনন করে আজ বাংলা তথা ভারতবর্ষের একমাত্র অবিসংবাদী নেত্রী মমতা বন্ধোপাধ্যায়। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আদর্শ ও অনুপ্রেরণা সর্বোপরি মানবসেবায় দিদির পথই আমার পথ।

 

নির্বাচন ২০১৬: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কু९সার ঝড় পেরিয়ে একটা বড় রাজনৈতিক সুনামি সামলে এলাম আমাদের জাতীয় উ९সব বাংলার দুর্গাপুজোর তিন মাস আগে। পুজো এসে গেলেই ‘জাগো বাংলা’র পুজো সংখ্যার জন্য একটা লেখার অনুরোধ আসে। সময়ের অভাবে যখনই কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে যাই অখন ওই ৪০/৪৫ মিনিট সময় যাতায়াতের রাস্তায় হাতে থাকে। আর যা থাকে, লেখার কাজ, তখন মেঘ-রৌদ্রে সেরে নিই আর কী!

এবারেও তার ব্যতিক্রম কোথায়? ২০১১ সালের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর বেসামাল আর্থিক ধস সামলেও পাঁচ বছর যে কাজ আমাদের সরকার মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদে করেছে তা এককথায় সাধ্যমতো চেষ্টায় অনবদ্য। যার ফলশ্রুতি ও বিশ্বাসে সাধারণ মানুষ তৈরি ছিলেন মনে মনে আশীর্বাদে ভালোবাসায় ও দোয়ায় আমাদের সমর্থন করতে।

কিন্তু হঠা९ করে নয়। বেশ পরিকল্পনা করে একেবারে দিল্লি থেকে কলকাতা! কিন্তু এবারের ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল প্রতিদিন, তা সত্যি সত্যিই চাক্ষুষ করলেন সাধারন মানুষ।

উপলব্ধির গভীরে চক্রান্তর শিকড় এতটাই নিমজ্জিত ছিল যে কখনও কখনও কু९সা কথার জ্বালায় প্রখর দেবতাও প্রায় দগ্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। আর আমার কান সবতা এলেও আমার knowledge  -এ সবটা থাকলেও, আমি আমার মতো  মার্চ-এপ্রিল মাস, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রখর রৌদ্র দহনের দারুন অগ্নিবাণে আর শুষ্ক ধুলোর, গ্রীষ্ম ধুলায় কিঞ্চি९ জ্বলনে, দহনে দগ্ধ হচ্ছিলাম। তাই সব কিছু দেখেও মানুষের প্রতি বিশ্বাসের জোরে মানব বৃক্ষের ছাতার তলে আশ্রয় নেওয়ার ফলে মনের বিশ্বাস-এর রাস্তাটা আমার কাছে এতটাই অক্ষত ছিল যে আমি আমি নিজেকে কখনওই দুর্বল মনে করিনি। শুধু ভাবতাম এত গরমের দিনে টানা আড়াই-তিন মাস প্রতিদিন প্রচার চালিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রচারটা শেষ করতে পারব তো? এক জেলা থেকে আর এক জেলা কখনও বা দিনে দুটো তিনটে জেলা কভার করতে হত।

আর তার মধ্যেই আসত নানারকম চক্রান্ত ও অভিসন্ধিমূলক খবরের খবর। দিল্লি থেকে কলকাতা যেভাবে আমাদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নির্বাচনের সময়েও সমস্ত নীতি বিসর্জন করে এক রাজনৈতিক অভীলিপ্সা যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে লাঞ্ছনা করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। আমাদে দলের কর্মীরা বহু কঠিন পরিস্থিতি ও আন্দোলন থেকে উঠে আসা বলেই এত বড় একটা অসম লড়াই করেও মানুষের আশীর্বাদে ও শুভেচ্ছায় জিতে এসেছে।

আমরা জিতিনি, জিতেছে মানুষ। এ লড়াই থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে।

Big Money power কীভাবে রাতারাতি জোট সরকার তৈরি করে ফেলেছিল, জোট সরকারের হোতাবাবুরা – কীভাবে সংবাদমাধ্যমের এক বড় অংশ, দিল্লির প্রভাবশালী চক্রব্যূহ সব একসঙ্গে একজোট হয়ে অনৈতিক নির্বাচনের সুযোগে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আমাদের, যা সব সীমাকে ছাড়িয়ে এক সীমাহীন সন্ত্রাসের সন্ত্রাসী বিস্ফোরণ।

এমন কোন জায়গা ছিল না বাকি এমনকি প্রশাসনকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি, সর্বত্রই খবরদারি করার, সর্বোচ্চ পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিকল্পিত হয়েছিল। এমনকি সব সৌজন্যকে বিসর্জন দিয়ে, আমি যেখানে থাকি, সেখানে আমাকেও হারানোর জন্য ভোটের আগের দিন আমাদের পাড়ার প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোতেও বিরোধী দলগুলোর মাতব্বরদের কথায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আগে শুধু ভোটকেন্দ্রের সামনে ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হত, আর এবার একেবারে এক অঘোষিত কারফিউ জারি করে সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের উ९সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সবরকম চক্রান্ত করা হয়েছিল। একসঙ্গে চার-পাঁচ জনকে এমনকি ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের ভোট পুলিশ। এলাকায় এলাকায় নির্বাচন কমিশনের পদ্ধতি মেনে অনুমতি নিয়েও বুথ ক্যাম্প করতে দেওয়া হয়নি।

অনেক কাছ থেকে অনেক ঘটনা জেনেছি নির্বাচনের দিনগুলোকে কেন্দ্র করে। আমাদের দীর্ঘদিনের সাথী শোভনদা, মানে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জিনি সারা জীবন রাজনৈতিক শ্রমিক আন্দোলন অথবা বিভিন্ন খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত, আমাকে বললেন, “জানিস তো মমতা, আমি রাসবিহারীর প্রার্থী হিসেবে যোধপুর পার্কের একটা ভোট কেন্দ্রে আইন অনুযায়ী ভোট কেমন চলছে দেখতে গেছি, আমাকে কয়েক জন ভোট পুলিশ (CRPF) ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আমি বললাম, ভাই আমি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী। আমার অনুমতি আছে ভিতরে যাওয়ার। ওই ভোট পুলিশগুলো বলল, “আপ তৃণমূল কংগ্রেস কা হ্যায়। আপলোগ কি খিলাপমে action করনা হামারা দিল্লিকা instruction হ্যায়। বলে ধাক্কা দিয়ে আমাকে বের করে দিল”। শোভনদা বলেছিলেন, “জানিস তো লজ্জায় আর অপমানে আমার মাথায় আগুন চেপে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের যাতে ভোটে কোনও অসুবিধা না হয় তাই সব সহ্য করেছি। এই ঔদ্ধত্য? বহিরাগতদের! যা চিরকাল মনে থাকবে।

শোভনদা আমাকে আরও জানান, “জানিস তো তোর সুপ্রিয়া বৌদি (মানে শোভনদার স্ত্রী) দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে শয্যাশায়ী। থাকেন ভবানীপুরে”। তাঁকে immediate  হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। Ambulance কে ফোন করলাম, জানতে পারলাম ভোট পুলিশরা Ambulance যেখানে থাকে সেখানে তালা দিয়ে চলে গিয়েছে”।

মেডিসিনের দোকান থেকে খাবারের দোকান সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নকুরের মিষ্টির দোকানে, তাদের মারধর করা হয়েছিল। এ-ঘটনাটা তো সবার জানা।

আমার পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমাকে জানালেন, “ম্যাডাম আমি ভোট দিতে যাচ্ছিলাম, কয়েকজন ভোট পুলিশ ভোটকেন্দ্রের বাইরে আমাকে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করছিল। যাতে আমি ভোট দিতে না যাই। এবার আমি আমার পরিচয় দিলাম, তখন বলছে, ‘সব গন্ধা হ্যায়”। অর্থা९ এইভাবে, যেভাবে বিশেষ নির্দেশনায় এবার নির্বাচন করা হয়েছে, তা যেকোনও জরুরি অবস্থার থেকে ভয়াবহ বলা যেতে পারে।

প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ জনের মতো ভালো ভালো অফিসারকে সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের কথায় যেভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর তাদের পছন্দমত লোকজনদের দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছিল তাও ভবিষ্য९ ইতিহাসের অনৈতিক অনেক সাক্ষী হয়ে থাকবে।

ভোটের দুদিন আগে থেকে এলাকায় এলাকায় গিয়ে আমাদের নেতৃবৃন্দ ও সংগঠকদের উপরে যেভাবে সন্ত্রাস করা হয়েছে তা গণতান্ত্রিক ইতিহাসে চিরদিনের চিরলজ্জা হিসাবে থাকবে।

এছাড়াও নানারকম অভিযোগ, মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে অনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অনেক তৃণমূল কংগ্রেসির বিরুদ্ধে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ বারবার করা হয়েছে তার কোনও একটারও বিচার হয়নি।

অভিযোগ দেখা যার দায়িত্বে ছিল, তিনি নাকি সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপিরটা দেখলেই তাঁর জিভ দিয়ে জল পড়ত। আর তৃণমূল কংগ্রেসের পত্র দেখলেই তাঁকে সরিয়ে রাখতেন। এই তো ২০১৬-র নির্বাচনী বৃত্তান্ত। জোটের কর্ণধাররা যারা অর্থ, দিল্লি সহ ভোট পুলিশ প্রশাসনের এক বড় আমলা, দিল্লির সবরকম মদত ও ইশারায় বাংলা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একতরফা চক্রান্ত করেছিলেন তাদের সব চক্রান্ত থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা ও দোয়ায় এ নির্বাচনী ফলাফল সত্যিই ভাবা যায় না। এ দান যে কত বড় দান সে তো চক্রান্তের নারদমুনিদের দেখলেই বোঝা যায়।

তা সত্ত্বেও শেষ হাসি মানুষের। সত্যের জয় মানুষের। বিশ্বাস ও আস্থার জয়- গণতন্ত্রের। অনেক শিক্ষা, অনেক অভিজ্ঞতা ও অনেক চক্রান্ত ও কু९সার ঝড় পেরিয়ে ২০১৬-র নির্বাচন গণতন্ত্রকে নতুন করে সমৃদ্ধ করল। যার থেকে বড় শিক্ষা। ‘মানুষের থেকে বড় কেউ নয়’।

গণতন্ত্রের প্রধান ভরসা মানুষ। চক্রান্তের ব্লুপ্রিন্ট নয়।

মা-মাটি-মানুষকে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই। ‘পুজো’ সকলের খুব ভালো কাটুক। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবার জন্য রইল প্রিয় দুর্গাপুজোর ‘শিউলি উ९সবে’ আমাদের প্রাণভরা শুভেচ্ছা। বড়দের প্রণাম-সালাম। ছোটদের নবীন প্রজন্মকে অনেক অভিনন্দন ও ভালবাসা।

শুভ পুজোর বাজনা বাজুক সবার ঘরে ঘরে।

 

 

Jago Bangla 2016 Festive Edition

জাগো বাংলা উৎসব সংখ্যা ১৪২৩

মা মাটি মানুষের পক্ষে সওয়াল

বিশেষ আকর্ষণ: ষড়যন্ত্র ও কুৎসা উড়িয়ে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়। কলম ধরলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এছাড়াও গল্প, কবিতা, সাহিত্য নিয়ে একাধিক লেখা বিশিষ্টজনদের কলমে

বছরটি বাঘা যতীনের আত্মবলিদানের শতবর্ষ: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যায়, বয়ে চলে মানুষের অনন্ত প্রবাহ। সেখানে কত সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী , শিল্পী ও দেশপ্রেমিকের আবির্ভাব ও তিরোভাব ঘটে সেই অনন্ত প্রবাহের মধ্যে। কিছু নাম সর্বকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে। বর্তমান বছরটি বিপ্লবী বাঘা যতীনের আত্মবলিদানের শতবর্ষ।

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় কাপ্তিপদায় ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং পর দিবসে ভোরে বীরের মত মৃত্যু হয়।

পিতা উমেশচন্দ্র এবং শর९শশী। তাঁর জন্ম হয়েছিল মাতুলালয়ে ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। পৈর্তৃক নিবাস ছিল যশোর জেলার ঝিলাইদহ মহকুমায় রিশখালী গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে যতীনের পিতৃবিয়োগ ঘটে, ফলে লেখাপড়া শুরু হয় মাতুলালয়ে। কৃষ্ণনগরের এ.ভি. স্কুল থেকে ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর এফএ পড়তে কলকাতা এলেন, ভর্তি হলেন উত্তর কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজে, যা বর্তমানে ক্ষুদিরাম বসু কলেজ নাম পরিচিত। যৌবনে নিজের জন্মভূমি কয়া গ্রামে একটি ধারালো ছুরি দিয়ে বাঘ শিকারের জন্য বাঙালি স্মৃতিতে তিনি বাঘা যতীন নাম চিরজীবী হয়ে রইলেন। চাকরিজীবনে খুব দ্রুত সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। খাস ছোটলাটের অফিসের কর্মচারী ছিলেন। যতীন্দ্রনাথের গোপন নির্দেশে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত ১৯১০ সালের ২৪ জানুয়ারী কলকাতা হাই কোর্টের ভিতরে এক গোয়েন্দা কর্তাকে খুন করেন। এই ঘটনার তিন দিন পরে ২৭৫ আপার চি९পুর রোডের বাস স্থান থেকে পুলিস গ্রেফতার করে যতীন্দ্রনাথকে। তখন তিনি তিনটি নাবালক সন্তানের পিতা। যতীন্দ্রনাথ আসলে এই দেশে বিপ্লব যজ্ঞ পরিচালনার প্রধান পুরোহিত। কয়েকবার স্বামীজির সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ বাঘাযতীন সম্পর্কে বলেন, “অদ্ভূত লোক, সমগ্র মানবজাতির মধ্যে একেবারে প্রথম শ্রেণীর পুরুষ, সৌন্দর্য্য আর তেজের এমন সমন্বয় আমি দেখিনি…।” স্বামীজির জ্বলন্ত দেশপ্রেম ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ, আত্ম९সর্গের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার বাণী; দুর্গত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান’ এসবই তো স্বামীজির নতুন ভারত গঠনের জন্য যুব সমাজের প্রতি আবেদন।

আজ আমাদের যুবসমাজের প্রথম শিক্ষা হওয়া উচিত শৃঙ্খলাবোধ, তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিল, “সৈন্যদল দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবল জনতার দ্বারা নহে। ” এটা যুবকদের বুঝতে হবে প্রকৃতির রাজত্বে অনিয়মের অস্তিত্ব নেই, বিশ্ব সৃষ্টির সব কিছুই নিয়মে চলে, সৈন্যদলের শৃঙ্খলাই যুদ্ধ বিজয়ের সর্ব শ্রেষ্ঠ উপকরণ। তাই প্রবাদ আছে The battle of Waterloo was won at the playground of Eton. বিশ্বত্রাস নেপোলিয়নকে ডিউক অব ওয়েলিংটন তার ইটন স্কুলে ছাত্রজীবনে শেখা শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষায়।

হাল ভাঙা, পাল ছেঁড়া নৌকা তরঙ্গ ক্ষুব্ধ সমুদ্রবক্ষে যে অবস্থা হয়, আমাদের বিশৃঙ্খল জীবনের পরিণামটিও তদনরূপ, অলস উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির জীবন যেমন দুঃখে ভরা, তেমনি যে সমাজ ও রাষ্ট্র বিশৃঙ্খল, তা নৈরাজ্যের রাহুগ্রস্ত, তার উন্নতি, অগ্রগতি নেই, গৌরবও নেই। রণাঙ্গনে, খেলার মাঠে, সংসার জীবনে, কর্মক্ষেত্রে শৃঙ্খলাপরায়ণ না হলে জয়ের আনন্দ, সাফল্যের হাসি, ভাগ্যলক্ষ্মীর প্রসন্নতা কিংবা খ্যাতি প্রতিপত্তি কিছুই মেলেনা, সবই মরীচিকার মায়া হয়ে জীবনকে হতাশা-নিরাশার মরু জ্বালায় জর্জরিত করে।

আজকের যুব সমাজকে বুঝতে হবে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা পরস্পর পরিপূরক। প্রচলিত বিধিবিধান, অনুশাসন, রীতি-নীতির আনুগত্যের নাম শৃঙ্খলা আর সেগুলির অনুসরণে জীবনযাত্রা এবং কর্ম সমাপনকে বলে নিয়মানুবর্তিতা। যেমন বিস্ববিধানের নিয়ম আছে বলেই, দিন-রাত, ঋতু বদল ইত্যাদি ঘটে। সমাজে রাজনীতি সবাই মান্য করে, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা থাকায় কোথায় অঘটন ঘটে না, সবাই হয় কর্তব্যপরায়ণ, আর তাতেই ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের অগ্রগতি, উন্নতি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সর্বব্যাপক শান্তি ও সুস্থিতি।

যুবসমাজকে বুঝতে হবে ‘পৌরুষ’ অর্থে বীরবিক্রম নয়, বাহুশক্তির আস্ফালন নয় কিংবা গলাবাজিও নয়, দৃঢ় প্রত্যয়, দৃঢ় সংকল্প, সূক্ষ্মবিচার বুদ্ধি, অনুশীলন ও সৃজনশক্তি, কর্মনিষ্ঠ চিত্তের সুকুমার বৃত্তিগুলির পরিচর্যা ও পরিস্ফুটন, ব্যবহারের সৌজন্য, শিষ্টতা, সামাজিক বোধ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা প্রভৃতির সম্মিলিত রূপটিই পৌরুষ ও পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব, যুব বয়সেই এগুলি আয়ত্তের প্রকৃষ্ট সময়।

এইকথাগুলি বইয়ে পড়েছি, বাড়িতে গুরুজনদের মুখ থেকে শুনেছি কিন্তু এই গুনগুলি যার মধ্যে চাক্ষুষ দেখেছি তিনি আর কেউ নন, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের নয়নমণি, মা-মাটি-মানুষের নেত্রী; বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের লক্ষে নিবেদিতপ্রাণ-শ্রদ্ধেয়া জননেত্রী মমতা ব্যানার্জি। স্বামী বিবেকানন্দের ‘কর্মযোগে’ দীক্ষিতা হয়ে যিনি সেই ছাত্রজীবন থেকে মানুষের সেবায় অহোরাত্র পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে যদি আদর্শের লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে জনগণের আশীর্বাদে একদিন অবশ্যই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। কোনও প্রলোভন বা ভয় দেখিয়ে আদর্শের লড়াইকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

২০১১ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্বপ্নের দিশারি হিসেবে সমস্ত, প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে নিদারুণ আর্থিক অনটনকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রাণপাত করে চলেছেন এবং তাঁর অদম্য জেদ, অধ্যবসায়, নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা, একদিন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, স্বামীজি, বাঘাযতীন ও শত শত বাঙালি মনীষীর স্বপ্নের পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্গরাজ্যে পরিণত করবে।

আসুন, আগমনির আগমনে সমস্ত বাঙালি যখন আনন্দে মাতোয়ারা তখন আমরা সমস্ত শক্তি নিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াই, মহিষাসুরমর্দিনীর কাছে শপথ গ্রহণ করি, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অগ্নিকন্যার সংগ্রামে আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনার মতো তাঁর আদেশ পালন করে যাব।

‘অরন্যে রণে দারুণ শত্রু মধ্যে অনলে সাগরে প্রান্তরে রাজগৃহে
ত্বমেকা গতির্দ্দেবি নিস্তার হেতু নমস্তে জগত্তারানি ত্রাহি দুর্গে।“