গণতন্ত্র রক্ষা ও তাকে মর্যাদা দেওয়ার একমাত্র শর্ত নিয়ে ১৯৯৮ সালে তৈরী হল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই থেকে লড়াই শুরু। বাংলার বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরি, ভোটাধিকার-সহ মানুষের গণতান্ত্রিক ন্যূনতম অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু করলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। আর যেহেতু গণতন্ত্রের জন্য লড়াই, সেজন্যই তা সবচেয়ে কঠিন।
একদিকে বামফ্রন্ট, আর অন্যদিকে কংগ্রেস তখন বাংলার মা-মাটি-মানুষের স্বার্থ পদদলিত করছে। লড়াই-আত্মত্যাগের বিনিময়ে মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে লড়াই শুরু করলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। অন্যদিকে, ঘটে চলেছে রাজনৈতিক খুন। রাজনীতির নামে খুন হচ্ছে সাধারণ মানুষ।পাহাড় জ্বলছে।অশান্ত জঙ্গলমহল।দরিদ্র মানুষের মুখে সামান্য অন্ন তুলে দেওয়ার নামে চলছে নোংরা রাজনীতি। লড়াই আরও কঠিন হল। দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিলেন জননেত্রী। চলতে থাকলো সংগ্রাম।
এই অবস্থা থেকে এল ২০০৬ সাল। বাংলায় সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের স্বার্থ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেল। রক্তাক্ত হলো সিঙ্গুরের মাটি। নিজের জীবন বাজি রেখে কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনশনে বসলেন জননেত্রী। তার পর ২০০৭-এ নন্দীগ্রাম। মমতার লড়াইকে সামনে রেখে রুখে দাঁড়াল নন্দীগ্রামের মানুষ। পরের বছর ২০০৮-এ ঘটে গেলো রিজওয়ানুর রহমান খুনের মতো ঘটনা। একটি সম্পর্ককে স্রেফ শ্রেনির বিচারে মর্যাদা না দিতে চেয়ে বাম-ঘনিষ্ট শক্তি খুন করল এক তরতাজা প্রতিভাবান মুসলিম যুবককে। দক্ষিন কলকাতা লাগোয়া তপসিয়ার ঘুপচি গলিতে তাঁর পরিবারের পাশে, তাঁর মায়ের পাশে ছুটে গেলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলায় পরিবর্তনের বাতাবরণ তৈরী হতে শুরু করল।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে সেই পরিবর্তনের শুরু। মানুষ যে জনস্বার্থ-বিরোধী সিপিএম ও কুচক্রী কংগ্রেসকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তা স্পষ্ট হতে থাকল। পঞ্চায়েতের ৫১ হাজার আসনের মধ্যে মানুষের সমর্থন নিয়ে ৩৯ হাজার আসনে প্রার্থী দিল তৃণমূল কংগ্রেস। জয় এলো ২৯ হাজার আসনে। শুরু হল তৃণমূলের জয়যাত্রা। এর পর ২০০৯-এ লোকসভা আসনে নিজেদের পদক্ষেপ আরও স্পষ্ট করে রাজ্যে ভিত শক্ত করতে শুরু করলো তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরের বছরই পুর-নির্বাচন। কলকাতা পুরসভা-সহ ৮৭টি পুরসভার নির্বাচনে বাংলায় পরিবর্তনের সূচনা হল। তারপর ২০১১ সাল। মানুষের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে গণতন্ত্রের জয় হল। মানুষ আশীর্বাদ করে বাংলার ক্ষমতা তুলে দিল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে। মানুষের কাছে যে অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, শুরু হলো সেই প্রতিশ্রুতি, সেই অঙ্গীকার রক্ষার কাজ। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সিঙ্গুরের কৃষিজমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হল। বিল আনলেন জননেত্রী। কিছু আইনি প্রক্রিয়ায় সেই বিল আটকে গেল হাই কোর্টে। মামলা গেল সুপ্রিম কোর্টে।
তার মধ্যেই কিন্তু চলছে দলকে অনুশাসনে বাঁধার পালা। সঙ্গে সরকার চলছে বাংলার মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। একেবারে নিজের পরিশ্রমে মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে নিজের বুধ্ধিমত্তার জোরে একের পর এক সরকারি প্রকল্প ঘোষণা। ইতিমধ্যে একদিকে জঙ্গলমহল, উল্টোদিকে পাহাড়কে শান্ত করে ফেলেছেন বাংলার নেত্রী। এর পরই শুরু হল বাংলার মানুষের জন্য একের পর এক প্রকল্প নেওয়া। মানুষ কেন জননেত্রীর ওপর ভরসা রাখবেন না? একার পরিশ্রমে, একার বুধ্ধিমত্তায় আনলেন কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প। যা এখন গোটা দেশ, গোটা বিশ্বের কাছে মডেল। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরে-কিশোরীদের জন্য সবুজসাথী, যুবক-যুবতীদের জন্য এল যুবশ্রী। বেকারদের সাহায্যার্থে একাধিক প্রকল্প। সরকারি সহায়তায় ঋণ দিয়ে বেকারদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর পালা। মাথায় রাখতে হবে, বাংলার সরকারের ঘরে তখন আড়াই লক্ষ কোটি টাকার ঋণ। মানুষকে ঠকিয়ে বামফ্রন্ট রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে গিয়েছে সেই ঋণ। তার মধ্যে কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে বারবার দরবার করেও মিলছে না সুরাহা। এই সার্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের কথা জাতীয় স্টোরে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি মর্মে উপলব্ধি করলেন সেই মমতা বন্দোপাধ্যায়। বুঝলেন বাংলায় উন্নয়নের কাজ মসৃনভাবে চালিয়ে যেতে গেলে কেন্দ্রের ক্ষমতাকেও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তবেই বাংলার অধিকার রক্ষিত হবে। রক্ষিত হবে বাংলার প্রকৃত স্বার্থ।কারণ কেন্দ্র সরকার যেভাবে বাংলার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে, সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, যেভাবে একের পর এক প্রকল্পে রাজ্যের বরাদ্দ ছাঁটাই করছে, তার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজন কেন্দ্রে ক্ষমতা বদল। সেই প্রেক্ষাপটেই দেশজুড়ে সমমনোভাবাপন্ন শক্তিগুলিকে একজোট করে ফেডারেল ফ্রন্ট গঠনের ডাক দিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।
পরিস্থিতির দাবিতে শুরু হল বাংলার বাইরে পা রাখা। এ কথা না বললেই নয় যে, এই গোটা পথ এক হেঁটেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরা, ওড়িশা, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশও তৃণমূলনেত্রীকে আহ্বান জানাল। সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিন ভারতেও একইসঙ্গে বাড়ছে দলের গ্রহণযোগ্যতা। এই অবস্থায় রাজ্যে কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে অভিমান তৈরী হল। দলীয় কিছু নেতার বিরুদ্ধে সেই অভিমান নিয়েও ব্যবস্থা নিলেন জননেত্রী। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, মানুষের স্বার্থে লড়াই তাঁর প্রধান শর্ত। সেই নীতি থেকে তিনি সরবেন না। ফলে মানুষ সমস্যায় পড়ে এমন কোনও ঘটনা ঘটলে তিনি বরদাস্ত করবেন না। তাই মানুষের পাশে থাকতে হবে। তাদের সঙ্গেই চলবে উন্নয়নের কাজ।
মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দলকে অনুশাসনে বেঁধে, কি দূরদর্শিতায় জননেত্রী বাংলার ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন, তা বোঝা যাবে নেত্রীর নিরলস প্রয়াসে। রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি বেকার সমস্যা সমাধানে শিল্প যে কতটা জরুরি, মমতা তা বুঝিয়ে দিলেন।
বিশ্ববাংলা সম্মেলনের আয়োজন করলেন জননেত্রী। যেখানে আম্বানি থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বহু শিল্পোদ্যোগীকে আহ্বান জানালেন। মমতা বুঝিয়ে দিলেন কৃষির ওপর ভিত্তি করেই শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে। তবেই রাজ্যের উন্নয়ন দ্রুত সম্ভব। শুরু হল জননেত্রীর আহ্বানে রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনা। স্কিল ডেভেলপমেন্ট থেকে ছোট ছোট সহযোগিতার মাধ্যমে রাজ্যে শিল্পের বাতাবরণ তৈরী হতে থাকল। শিল্প-সম্ভাবনা আরও জোরদার হল। শিল্পের প্রয়োজনে বিদেশের মাটিতে পা রাখলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলার শান্ত পরিবেশে শিল্পের আরও নানা দিক খুলতে লাগল। বাংলার হাত ধরতে শুরু করলো বিশ্ব। বিশ্ববাংলার রূপ পেতে শুরু করলো রাজ্য।
পাঁচ বছরের এই সার্বিক প্রচেষ্টার সুফল হাতে নিয়ে যখন মানুষের সামনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, বিরোধী দলগুলি একজোট হল। জোট বাঁধলো এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম। শুরু হলো লাগাতার ষড়যন্ত্র, কুত্সা, মিথ্যা প্রচার। মানুষকে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার চূড়ান্ত অপচেষ্টা। রাজ্যকে অশান্ত করে দেয়ার চক্রান্ত। রাজ্যে সেই রাজনৈতিক অশান্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে জনমতের ঝড় মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আবার পৌঁছে দিল মসনদে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যে আদপে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য, তার প্রমাণ দিয়ে মানুষই বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা মমতা বন্দোপাধ্যায়েই আস্থা রেখেছেন। কোনও অলীক কল্পনা নিয়ে কোনও ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে চান না মানুষ।
শুরু হল নেত্রীর দ্বিতীয় ইনিংস। আবার প্রতিষ্ঠিত হল গণতন্ত্র। দুর্নীতি, অপশাসন, মানুষের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই শেষ করে, মানুষের আশীর্বাদে জয় ছিনিয়ে এনে ষড়যন্ত্রের বাধা পার করে, রাজ্যের জন্য উন্নয়নের ডালি নিয়ে দলকে এক সুশাসনের মন্ত্রে বেঁধে বাংলার নতুন সূর্যোদয়ের দিকে চলেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সরকার ও দলকে চালানোর ক্ষেত্রে এবার তিনি আরও কঠোর। এই ধাপেই সুপ্রিম কোর্টের রায় এনে দিল নতুন জয়। জীবন বাজি রেখে সিঙ্গুরের জন্য যে লড়াই জননেত্রী লড়েছেন, জয় হয়েছে সেই লড়াইয়ে। কৃষকদের হাতে ফিরেছে জমি। সঙ্গে আরও সম্ভাবনাময় হচ্ছে শিল্প-পরিস্থিতি। যা তাঁর একার কৃতিত্ব।