অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যায়, বয়ে চলে মানুষের অনন্ত প্রবাহ। সেখানে কত সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী , শিল্পী ও দেশপ্রেমিকের আবির্ভাব ও তিরোভাব ঘটে সেই অনন্ত প্রবাহের মধ্যে। কিছু নাম সর্বকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে। বর্তমান বছরটি বিপ্লবী বাঘা যতীনের আত্মবলিদানের শতবর্ষ।
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় কাপ্তিপদায় ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং পর দিবসে ভোরে বীরের মত মৃত্যু হয়।
পিতা উমেশচন্দ্র এবং শর९শশী। তাঁর জন্ম হয়েছিল মাতুলালয়ে ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। পৈর্তৃক নিবাস ছিল যশোর জেলার ঝিলাইদহ মহকুমায় রিশখালী গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে যতীনের পিতৃবিয়োগ ঘটে, ফলে লেখাপড়া শুরু হয় মাতুলালয়ে। কৃষ্ণনগরের এ.ভি. স্কুল থেকে ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর এফএ পড়তে কলকাতা এলেন, ভর্তি হলেন উত্তর কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজে, যা বর্তমানে ক্ষুদিরাম বসু কলেজ নাম পরিচিত। যৌবনে নিজের জন্মভূমি কয়া গ্রামে একটি ধারালো ছুরি দিয়ে বাঘ শিকারের জন্য বাঙালি স্মৃতিতে তিনি বাঘা যতীন নাম চিরজীবী হয়ে রইলেন। চাকরিজীবনে খুব দ্রুত সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। খাস ছোটলাটের অফিসের কর্মচারী ছিলেন। যতীন্দ্রনাথের গোপন নির্দেশে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত ১৯১০ সালের ২৪ জানুয়ারী কলকাতা হাই কোর্টের ভিতরে এক গোয়েন্দা কর্তাকে খুন করেন। এই ঘটনার তিন দিন পরে ২৭৫ আপার চি९পুর রোডের বাস স্থান থেকে পুলিস গ্রেফতার করে যতীন্দ্রনাথকে। তখন তিনি তিনটি নাবালক সন্তানের পিতা। যতীন্দ্রনাথ আসলে এই দেশে বিপ্লব যজ্ঞ পরিচালনার প্রধান পুরোহিত। কয়েকবার স্বামীজির সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ বাঘাযতীন সম্পর্কে বলেন, “অদ্ভূত লোক, সমগ্র মানবজাতির মধ্যে একেবারে প্রথম শ্রেণীর পুরুষ, সৌন্দর্য্য আর তেজের এমন সমন্বয় আমি দেখিনি…।” স্বামীজির জ্বলন্ত দেশপ্রেম ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ, আত্ম९সর্গের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার বাণী; দুর্গত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান’ এসবই তো স্বামীজির নতুন ভারত গঠনের জন্য যুব সমাজের প্রতি আবেদন।
আজ আমাদের যুবসমাজের প্রথম শিক্ষা হওয়া উচিত শৃঙ্খলাবোধ, তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিল, “সৈন্যদল দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবল জনতার দ্বারা নহে। ” এটা যুবকদের বুঝতে হবে প্রকৃতির রাজত্বে অনিয়মের অস্তিত্ব নেই, বিশ্ব সৃষ্টির সব কিছুই নিয়মে চলে, সৈন্যদলের শৃঙ্খলাই যুদ্ধ বিজয়ের সর্ব শ্রেষ্ঠ উপকরণ। তাই প্রবাদ আছে The battle of Waterloo was won at the playground of Eton. বিশ্বত্রাস নেপোলিয়নকে ডিউক অব ওয়েলিংটন তার ইটন স্কুলে ছাত্রজীবনে শেখা শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষায়।
হাল ভাঙা, পাল ছেঁড়া নৌকা তরঙ্গ ক্ষুব্ধ সমুদ্রবক্ষে যে অবস্থা হয়, আমাদের বিশৃঙ্খল জীবনের পরিণামটিও তদনরূপ, অলস উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির জীবন যেমন দুঃখে ভরা, তেমনি যে সমাজ ও রাষ্ট্র বিশৃঙ্খল, তা নৈরাজ্যের রাহুগ্রস্ত, তার উন্নতি, অগ্রগতি নেই, গৌরবও নেই। রণাঙ্গনে, খেলার মাঠে, সংসার জীবনে, কর্মক্ষেত্রে শৃঙ্খলাপরায়ণ না হলে জয়ের আনন্দ, সাফল্যের হাসি, ভাগ্যলক্ষ্মীর প্রসন্নতা কিংবা খ্যাতি প্রতিপত্তি কিছুই মেলেনা, সবই মরীচিকার মায়া হয়ে জীবনকে হতাশা-নিরাশার মরু জ্বালায় জর্জরিত করে।
আজকের যুব সমাজকে বুঝতে হবে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা পরস্পর পরিপূরক। প্রচলিত বিধিবিধান, অনুশাসন, রীতি-নীতির আনুগত্যের নাম শৃঙ্খলা আর সেগুলির অনুসরণে জীবনযাত্রা এবং কর্ম সমাপনকে বলে নিয়মানুবর্তিতা। যেমন বিস্ববিধানের নিয়ম আছে বলেই, দিন-রাত, ঋতু বদল ইত্যাদি ঘটে। সমাজে রাজনীতি সবাই মান্য করে, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা থাকায় কোথায় অঘটন ঘটে না, সবাই হয় কর্তব্যপরায়ণ, আর তাতেই ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের অগ্রগতি, উন্নতি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সর্বব্যাপক শান্তি ও সুস্থিতি।
যুবসমাজকে বুঝতে হবে ‘পৌরুষ’ অর্থে বীরবিক্রম নয়, বাহুশক্তির আস্ফালন নয় কিংবা গলাবাজিও নয়, দৃঢ় প্রত্যয়, দৃঢ় সংকল্প, সূক্ষ্মবিচার বুদ্ধি, অনুশীলন ও সৃজনশক্তি, কর্মনিষ্ঠ চিত্তের সুকুমার বৃত্তিগুলির পরিচর্যা ও পরিস্ফুটন, ব্যবহারের সৌজন্য, শিষ্টতা, সামাজিক বোধ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা প্রভৃতির সম্মিলিত রূপটিই পৌরুষ ও পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব, যুব বয়সেই এগুলি আয়ত্তের প্রকৃষ্ট সময়।
এইকথাগুলি বইয়ে পড়েছি, বাড়িতে গুরুজনদের মুখ থেকে শুনেছি কিন্তু এই গুনগুলি যার মধ্যে চাক্ষুষ দেখেছি তিনি আর কেউ নন, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের নয়নমণি, মা-মাটি-মানুষের নেত্রী; বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের লক্ষে নিবেদিতপ্রাণ-শ্রদ্ধেয়া জননেত্রী মমতা ব্যানার্জি। স্বামী বিবেকানন্দের ‘কর্মযোগে’ দীক্ষিতা হয়ে যিনি সেই ছাত্রজীবন থেকে মানুষের সেবায় অহোরাত্র পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে যদি আদর্শের লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে জনগণের আশীর্বাদে একদিন অবশ্যই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। কোনও প্রলোভন বা ভয় দেখিয়ে আদর্শের লড়াইকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
২০১১ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্বপ্নের দিশারি হিসেবে সমস্ত, প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে নিদারুণ আর্থিক অনটনকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রাণপাত করে চলেছেন এবং তাঁর অদম্য জেদ, অধ্যবসায়, নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা, একদিন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, স্বামীজি, বাঘাযতীন ও শত শত বাঙালি মনীষীর স্বপ্নের পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্গরাজ্যে পরিণত করবে।
আসুন, আগমনির আগমনে সমস্ত বাঙালি যখন আনন্দে মাতোয়ারা তখন আমরা সমস্ত শক্তি নিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াই, মহিষাসুরমর্দিনীর কাছে শপথ গ্রহণ করি, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অগ্নিকন্যার সংগ্রামে আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনার মতো তাঁর আদেশ পালন করে যাব।
‘অরন্যে রণে দারুণ শত্রু মধ্যে অনলে সাগরে প্রান্তরে রাজগৃহে
ত্বমেকা গতির্দ্দেবি নিস্তার হেতু নমস্তে জগত্তারানি ত্রাহি দুর্গে।“